ফেব্রুয়ারির মর্যাদা কেবল একটি দিনের নয়

ও আমার মায়ের মুখের মধুর ভাষা, পরম অহংকারে, জড়িয়ে আছো, ছড়িয়ে আছো, সুরের অলঙ্কারে। হ্যা, মায়ের মুখের ভাষা তো অহংকারের-ই ধন। যে অহংকার কিংবা মর্যাদা রক্ষায় বুকের রক্ত দিতে হয়েছে বাঙালিদের। বোধকরি ভাষার জন্য রক্ত দেওয়ার গৌরব ও ইতিহাস কেবল বাঙালিদেরই আছে। আমাদের এই ভাষার সংগ্রাম একদিনের বিষয় নয়। দেশ ভাগের পর, অর্থাৎ ১৯৪৭ সাল থেকেই ভাষার সংগ্রাম শুরু হয়। ১৯৫২ সালে আমরা আমাদের সেই অধিকার অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। তাইতো ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস, এক মহান সংগ্রামী ঐতিহ্য হয়ে আছে। এখন আর একুশে ফেব্রুয়ারির মর্যাদা কেবল একটি দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখাটা ঠিক হবে না। কারণ, ৫২, ৬২, ৬৬, ৬৯ এবং ১৯৭১ আমদের অমিত সাহস যুগিয়েছে এই ফেব্রুয়ারির চেতনায়। আজ বাঙালির একুশ গোটা দুনিয়ার হয়েছে। এই গর্বের ও অহংকারের ধনও বাঙালির।
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি...’ এই গান আজ বিশে^র প্রায় ২০০ দেশের মানুষ একসঙ্গে গেয়ে ওঠে। তাইতো আমরা বলি ‘মাতৃভাষার হয়েছে জয়, একুশ সারা বিশ^ময়।’ একুশে ফেব্রুয়ারি একটি বিশ^ দলিলের অংশ। ইউনেস্কো মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করায় বিশে^র দেশে দেশে আমার মায়ের মুখের ভাষার মর্যাদা আরো বেড়ে গেছে। তাই ব্যক্তি থেকে পরিবার, পরিবার থেকে সমাজ এবং রাষ্ট্রের সর্বত্র মতৃভাষার প্রচলন স্বাভাবিক করা দরকার। এখনো সর্বত্র বাংলা ভাষার প্রচলন হচ্ছে না। উল্টো বিদেশি ভাষা ব্যবহারের দিকেই বেশি ঝুঁকে পড়ছি।
আমরা চাই, সবার ভাষার মর্যাদা রক্ষা পাক। কিন্তু আগে তো আমার মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে হবে। আদালতে এখনো ইংরেজি ভাষার প্রচলনই বেশি। আমরা এটা দোষের মনে করছি না। আমরা বলতে চাই, ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি বাংল্ াভাষায়ও রায়সহ অন্যান্য কাজের প্রচল ঘটুক।
১৯৫২ সালেরও আগ থেকে মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবি ওঠে। সেই দাবির পক্ষে যেমন ছাত্ররা আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। সেই আন্দোলন বেগবান করতে রাজনৈতিক দলগুলোও ব্যাপক ভূমিকা রাখে। একই সঙ্গে তখনকার গণমাধ্যমও যুগপদভাবে দায়িত্ব পালন করে। সেখানেও কিন্তু ১৯৪৭ সাল থেকেই ভাষার দাবির কথা উঠে আসে। ১৯৪৭ সালের ২৯ জুলাই ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ স্ব-নামে ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায় লিখেছিলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে বাংলার দাবীকে অগ্রগণ্য।’ তিনি বলেন, ‘যদি এরপরেও অন্য কোন ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রশ্ন আসে, শুধু তা হলেই উর্দুর কথা চিন্তা করা যেতে পারে।’ সেদিন আন্তর্জাতিকভাবে ভাষার দাবি তুলে ধরতে গণমাধ্যম উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। এখানে বলা দরকার, তখন, গণমাধ্যম বলতে শুধু পত্র পত্রিকা ও পুস্তিকা বুঝানো হচ্ছে। কেননা তখনো এদেশে টেলিভিশন নেটওয়ার্ক ছিলো না। টেলিভিশন আসে ১৯৬৪ সালে।
সেই সময়ে বাংলাকে এতটা প্রাধান্য দেওয়া হলেও আজ সেটা হচ্ছে না। আজ কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে দেখার প্রচলন শুরু হয়েছে। আমাদের এখান থেকে বের হতেই হবে।
মোদের গরব মোদের আশা, আমরি বাংলা ভাষা’ অতুলপ্রসাদ সেনের এই কথা প্রতিটি বাঙালিরই মনের কথা। মা, মাটি আর মুখের বোল- এই তিনে মনুষ্য জন্মের সার্থকতা। নিজের মুখের ভাষার চেয়ে মধুর আর কিছু হতে পারে না।
বাঙালি বায়ান্ন সালে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে শত্রুর হাত থেকে ছিনিয়ে এনেছিল মায়ের মুখের ভাষাকে। বাংলা মায়ের দামাল ছেলেদের বুকের রক্তে সেদিন রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিল। রফিক, সালাম, বরকত, শফিউরসহ নাম না জানা অসংখ্য শহীদের রক্তস্নাত এই অর্জন বিশ্বে বাঙালিকে অমর করে রেখেছে। তাই ফেব্রুয়ারির (একুশের) মর্যাদা কেবল একটি দিনের নয় সারা বছর থাকে সেই প্রত্যাশা করছি।