বরিশাল অশ্বিনী ভবন কথা

বরিশাল অশ্বিনী ভবন কথা

আশ্বিনীকুমার দত্ত (১৮৫৬-১৯২৩) বরিশাল কালিবাড়ি রোডে নিজস্ব ভবনে বসবাস করতেন। ১৯২২-এর আগস্ট মাসে আশ্বিনীকুমার দত্ত অসুস্থ শরীর নিয়ে কলকাতা যান এবং ১৯২৩ সালের ৭ নভেম্বর ডাক্তার নীলরতন দে’র চিকিৎসাধীন অবস্থায় সেখানেই মারা যান। অশ্বিনী ভবন ছিলো একটা বড়ো দোতলা বাড়ি যার উপরে চিলেকোঠা সংলগ্ন দুটি কক্ষ। দুইতলার প্রতি তলায় ছিলো ছয়টি করে কক্ষ এবং একটি বড় হলঘর, সামনে পিছনে বারান্দা; পিছনের বারান্দার সঙ্গে রান্নাঘর, স্নানঘর।

বাড়ির প্রধান ফটকে ঢুকতে ডান দিকের স্তম্ভে ছোটো নাম ফলকে লেখা ছিলো ‘অশ্বিনী ভবন কালীবাড়ী রোড, বরিশাল’।

আশ্বিনীকুমার দত্তর মৃত্যুর পর তার ভাইয়ের ছেলে সরলকুমার দত্ত এই বাড়িতে বসবাস করতেন। সরলকুমার দত্ত ছিলেন অত্যন্ত মেধাবি। কলকাতা বিশ্ববিদালয় থেকে গণিতে এমএসসি পরীক্ষায় প্রথম শেণিতে প্রথম হয়েও ব্রজমোহন কলেজে চাকরির দরখাস্ত করেননি। কারণ মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্ত’র নির্দেশ ছিলো ‘এই স্কুল কিম্বা কলেজ স্থাপন করিয়া আমি ও আমার পরিবারস্থ ব্যক্তিগণ কোন দিন কেহ কিছুমাত্র লাভের প্রত্যশা করি না ও করিবও না। এই স্কুল কিংবা কলেজের এক কপর্দকও আমার সংসারে যাইবে না, ইহা তুমি নিশ্চিত জানিও। বরিশালবাসী সকলে ইহার ফল ভোগ করিয়া জ্ঞানী, গুণী হউক- সুখ স্বচ্ছন্দতা লাভ করুক- ইহাই আমার একমাত্র কামনা’। (কালীপ্রসন্ন সেন; কর্মযোগী কালিপ্রসন্ন : পৃ. ৪১) অশ্বিনীকুমার দত্ত তাঁর সুহৃদ ব্রজমোহন কলেজের উপাধ্যক্ষ কালীপ্রসন্ন ঘোষকে এমন কথা বলেছিলেন। কালীপ্রসন্ন ঘোষ ছিলেন বরিশাল স্বদেশী আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তি। তিনি ছিলেন বিএ পাশ। ১৮৮৪ সালে ব্রজমোহন বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে তিনি এর প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৮৮৯ সালে কলেজ প্রতিষ্ঠা হলে অশ্বিনীকুমার দত্ত তাঁকে কলেজের উপাধ্যক্ষ নিয়োগ করেন এবং ১৯২৬-এর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ আমৃত্যু প্রায় সাইত্রিশ বছর তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর মৃত্যুর পর কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁর নামে কলেজের বিজ্ঞান ‘গ্যালারি হলে’র নামকরণ করেন। এই হলটি তাঁরই উদ্যোগে নির্মিত। ব্রজমোহন কলেজে আজও সেই কালীপ্রসন্ন বা ‘কেপি হল’ তাঁর স্মৃতি বহন করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রসঙ্গত ১৯১৮ সনের দিকে ব্রজমোহন কলেজের অধ্যক্ষের পদ শুন্য হলে অশ্বিনী কুমার দত্ত’র আর এক ভ্রাতুষ্পুত্র সুশীল কুমার দত্ত সেই পদের জন্য আবেদন করেন। সুশীল কুমার দত্ত পিএইডি ডিগ্রিধারী এবং সবদিক দিয়ে উপযুক্ত বিবেচিত হওয়ার সত্বেও অশ্বিনী কুমার দত্তের আদর্শের ধারক এই কালীপ্রসন্ন ঘোষের আপত্তির কারণে কলেজ নির্বাহী পরিষদ তাঁকে নিয়োগ দিতে পারেনি।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আট বছর পর ১৯৫৫ সালে সরলকুমার দত্ত দেশ থেকে যাবার সময় ‘অশ্বিনী ভবন’ ব্রজমোহন কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে যান। ব্র্রজমোহন কলেজ তখন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। ব্রজমোহন কলেজ সরকারি হয় ১৯৬৫ সালে। কলেজ কর্তপক্ষ এই ভবনে প্রতিষ্ঠা করে ‘অশ্বিনী ভবন কসমোপলিটান ছাত্রবাবাস’।  বরিশালে এটিই ছিলো একমাত্র ‘কসমোপলিটান’ ছাত্রাবাস। ‘কসমোপলিটান’ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘বিশ্বজনীন’, ‘সর্বসঙ্কীর্ণতামুক্ত’ বা ‘উদার’। অর্থাৎ এই ছাত্রাবাস সকলের জন্য উন্মুক্ত। যেকোনো ধর্মবিশ্বাসী ছাত্রই এই ছাত্রাবাসের আবাসিক ছাত্র হতে পারবে। মহাত্মা অশ্বিনী কুমার দত্তের অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করেই তাঁর বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত ছাত্রাবাসের এমন বৈশিষ্ট্য। মনে রাখা জরুরি, পাকিস্তানী আমলের উগ্র ধর্মীয় পরিবেশের মধ্যে এমন একটি ছাত্রবাসের প্রতিষ্ঠা ছিলো একটি সাহসী পদক্ষেপ। অশ্বিনী ভবনের দুই তলায়ই ছাত্র থাকতো আর উপরে চিলেকোঠা সংলগ্ন কক্ষদ্বয় ব্যবহৃত হতো ছাত্রবাসের তত্বাবধায়কের আবাস হিসেবে। এই ছাত্রাবাসের তত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করেছেন ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক হেদায়েতুল ইসলাম খান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবুল কালাম এবং বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আসাদুজ্জামান এবং আরও কয়েকজন শিক্ষক। ১৯৬৫ পর্যন্ত এটি ব্রজমোহন কলেজের ছাত্রাবাস হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

১৯৬৩ বরিশালের কিছু উদ্যোগী ব্যক্তি মূলত বরিশালের জেলা প্রশাসন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এসএসসি বা এইচএসসি পাশ অফিস-সহকারী নিজেদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের প্রত্যাশায় একটি নৈশ কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এদের একটি প্রতিনিধি দল ব্রজমোহন বিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক জয়ন্ত কুমার দাশগুপ্তের সঙ্গে সাক্ষাত করে তাদের উদ্যোগের বিষয়টি জানান। জয়ন্ত কুমার দাশগুপ্ত তাঁর বিদ্যালয়ে নৈশকলেজ শুরু করার সম্মতি দেন এবং সেখানেই নৈশ কলেজের ক্লাস শুরু হয়। তিনি নিজে কলেজে বাংলা পড়াতেন। কলেজের নামকরণ করা হয় ‘বরিশাল নৈশ কলেজ’ বা ‘বরিশাল নাইট কলেজ’। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন জনাব আবদুল হক। ব্রজমোহন কলেজের কয়েকজন শিক্ষক এই কলেজে শিক্ষাদান করতেন। 

নৈশকলেজে ছাত্রসংখ্যা বেড়ে গেলে পৃথক ক্যাম্পাসের প্রয়োজন হয়ে পরে। তখন সবাই মিলে (জেলা প্রশাসন, নৈশকলেজ পরিচালনা পর্ষদ, ব্রজমোহন বিদ্যালয় ও কলেজ কর্তৃপক্ষ) নৈশকলেজ ‘অশ্বিনী ভবনে’ স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৬৫-তে নৈশকলেজ অশ্বিনীভবনে স্থানান্তরিত হয় এবং ‘অশ্বিনী ভবন কসমোপলিটান ছাত্রবাবাস’ বন্ধ হয়ে যায়।

এক পর্যায়ে কলেজ কর্তপক্ষ কলেজের স্থায়ী ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। প্রশ্ন ওঠে ‘অশ্বিনীভবন’ এবং কলেজের নামকরণ নিয়ে। কলেজ-শিক্ষক পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কলেজের দুজন শিক্ষক পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা যান মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্তের উত্তরাধীকারদের সঙ্গে কথা বলতে। মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্ত ছিলেন নিঃসন্তান। তাই তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রদের উত্তরাধিকারদের সঙ্গে দেখা করে শিক্ষকদ্বয় প্রস্তাব দেন, দুই লক্ষ টাকা দান করলে কলেজটির নাম অশ্বিনীকুমার-এর নামে হতে পারে। তাঁরা সেই প্রস্তাবে রাজি না হলে অধ্যাপকদ্বয় দেশে ফিরে আসেন। পরে তাদের এবং জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ‘অশ্বিনী ভবন’ ও এর বিষয়সম্পত্তি বরিশাল নৈশ কলেজের নামে অধিগ্রহণ করা হয়। ১৯৭০ সালে। এর প্রশাসনিক অনুমোদন পত্রে উল্লেখ আছে ‘বরিশাল নৈশ কলেজের জন্য জমি অধিগ্রহণ’। দেশ স্বাধীনের নৈশ কলেজে ‘দিবা শাখা’ খোলা হয়। কলেজে দীর্ঘদিন নৈশ ও দিবা উভয় শাখা চালু থাকে। নৈশ শাখায় ছাত্র সংখ্যা কমতে থাকলে গত শতকের সাতের দশকের শেষের দিকে ‘নৈশ শাখা’ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে কলেজের নাম থেকে ‘নৈশ’ কথাটিও বিলুপ্ত হয়ে যায়। 

১৯৮৬ সনের ১৪ নভেম্বর কলেজটি জাতীয়করণ করা হয়। জাতীয়করণের পর সরকারি অর্থায়নে মূল অশ্বিনী ভবনের পিছনে একটি ভবন নির্মিত হয়। মূলত প্রশাসনিক ভবন হিসেবেই এই ভবন। এভাবেই চলতে থাকে সরকারি বরিশাল কলেজ। অমরা তা দেখেছি মহাত্মা অশ্বনী কুমার দত্তের ব্যবহৃত একটি খাট, একটি ছোটো পড়ার টেবিল এবং একজোড়া খড়ম দীর্ঘকাল (১৯৯২-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত) অশ্বিনী ভবনের চিলে কোঠায় সংরক্ষিত ছিল। 

১৯৯২-এর ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ একদিন ভেঙে ফেলা হয় মূল অশ্বিনী ভবন লুট করা হলো সেই খাট, পড়ার টেবিল, ছুঁড়ে ফেলা হলো খড়ম। হিসাব বলে ভারতের অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ভাঙার এক সপ্তাহের মধ্যেই ভবনাটি ভেঙে ফেলা হয়। এক উগ্র সাপ্রদায়িক কর্মকা-ের বহিঃপ্রকাশ বিবেচনা করে শহরের কয়েকজন প্রগতিশীল সমাজকর্মী সেখানে গিয়ে ভবন ভাঙায় বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে। ভবন ভাঙার কাজে নিয়োজিত বাহিনীর কাছে তাঁরা টিকতে না পেরে চলে আসেন। পরে তাঁরা কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর মকবুল উদ্দিন আহমদের সঙ্গে দেখা দেখা করে এর প্রতিবাদ জানালে তিনি কথা দেন হুবহু ‘অশ্বিনী ভবনের আদলেই এখানে একটি ভবন নির্মিত হবে।  সেই কথা আর বস্তবতার মুখ দেখেনি।

এর দশ বছর পর ২০০৩ সালের মে মাসে কলেজ কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নেয় অশ্বিনী ভবনের তমাল গাছটি কেটে সেখানে কলেজের প্রশাসনিক ভবন তৈরি করবে। সংবাদ পেয়ে শহরের সেই প্রগতিশীল সমাজকর্মীরা কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ এ কে এম শামসুদ্দিনের সঙ্গে দেখা করে এর প্রতিবাদ জানালে তিনি তমাল গাছ কাটা থেকে বিরত থাকেন। এবং কথা দেন তমাল গাছের নিচের চত্তরটি নতুন করে নির্মাণ করে দেবেন। তিনি তা করেননি। এসময় উপরিউক্ত প্রতিবাদকারী সমাজকর্মীরা উদ্যোগ নেন কলেজের মূল ফটকে (পুরাতন) একটি ‘পাকা স্তম্ভ’ তৈরি করে সেখানে ‘অশ্বিনী ভবন’ নাম ফলক প্রতিস্থাপন করা হবে। সেভাবে পুরাতন ফটকের ডান দিকে একটি স্তম্ভ তৈরি করা হয় এবং একটি নামফলকও তৈরি করতে দেওয়া হয়। কিন্তু সেসময়ে বরিশালের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশের কারণে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। সেই ‘স্তম্ভ’টি এখনো কালের সাক্ষি হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। 

অশ্বিনী ভবন কেবল একটি বাসস্থান বা ভবনই নয়। বলা যায় বরিশালবাসীর ঐতিহ্যের প্রতীক এই অশ্বিনী ভবন এবং অশ্বিনী ভবন তমাল তলা। এই বাড়িতে এসেছেন মহাত্মা গান্ধি, ব্যারিস্টার আবদুল্লা রসুল আনদুল হাকিম গজনভী, সুরেন্দ্রনাথ ব্যনার্জি প্রমুখ। ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের পীঠস্থান হয়ে উঠেছিলো এই ভবন। এখানে অনুষ্ঠিত হয়েছে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বের কুচকাওয়াজ। পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনের নানা সমাবেশ, অনুষ্ঠান। একুশের অনুষ্ঠান। দেশ স্বাধীনের পর এখানেই ছিলো ‘মুজিব বাহিনীর ক্যাম্প। বরিশালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠার (১৯৮৫) পূর্ব পর্যন্ত ‘অশ্বিনী ভবন তমাল তলাই ছিলো বরিশালের সামাজিক কর্মকা-ের মিলন কেন্দ্র।


অধ্যাপক বদিউর রহমান, সাংবাদিক ও সহসভাপতি, উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদ