বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচন উদাহারণ হোক

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচন নান্দনিক পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত ২৮ জানুয়ারি সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে ওই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থী বিজিত প্রার্থীকে ফুল দিয়ে বরণ করে নিয়েছে। এমন নির্বাচন অনন্য উদাহারণ সৃষ্টি করেছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। দেশের সকল নির্বাচন এমন পরিবেশ অনুষ্ঠিত হলে সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ় হবে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
নির্বাচনে সভাপতি পদে বিজয়ী মো. বাহাউদ্দিন গোলাপের নাম ঘোষণা করতেই এ পদে পরাজিত অপর প্রার্থী মো. রফিকুল ইসলাম সেরনিয়াবাত বিজয়ী প্রার্থীকে বুকে জড়িয়ে নেন ও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। এরকম নজির বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিরল। নির্বাচন কমিশন উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন বলেই এমনটা সম্ভব হয়েছে।
নির্বাচনকে ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও ভোটকেন্দ্রে প্রথমবারের মতো শোভা পায় নির্বাচন কমিশনের রঙিন পোস্টার ও ফেস্টুন। নির্বাচন আচরণবিধি ও নিয়মাবলি সম্বলিত বিশাল একটি ব্যানারে টাঙ্গিয়ে দেওয়া হয় ভোটকেন্দ্রে। ‘নো মাস্ক, নো ভোট’, ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে পছন্দ তাকে দেব’, ‘প্রতিযোগিতা নয় উৎসব, বিজয়ের মালা সবার হোক’, ‘হয় জিত নয় হার, করব না মন ভার’ এরকম নানা ফেস্টুন দৃষ্টি কাড়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, ভোটার, প্রার্থী, গণমাধ্যমকর্মী, শিক্ষার্থীসহ সবার।
কোভিড-১৯ পরিস্থিতি, নানা সীমাবদ্ধতা ও পারিপার্শ্বিক চাপের মধ্যেও কতটা নান্দনিক, নিরপেক্ষ, সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন নির্বাচন আয়োজন করা যায়, তারই উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন নির্বাচন ২০২১ এর প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন কথা সাহিত্যিক, কলামিস্ট ও ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স সেলের (আইকিউএসি) সহকারী পরিচালক এস. এম. আরাফাত শাহরিয়ার। নির্বাচন নিয়ে তাঁর নানা সৃজনশীল ও ব্যতিক্রমী উদ্যোগের প্রশংসা সবার মুখে মুখে। বরিশাল বিশ^বিদ্যালয়ে এত চমৎকার নির্বাচন কখনো প্রত্যক্ষ করেনি এমন মন্তব্যও শোনা গেছে। যেকোনো নির্বাচন থেকে এটি ছিল অনন্য, ব্যতিক্রম ও বৈচিত্র্যময়।
এস. এম. আরাফাত শাহরিয়ার নির্বাচনের শুরুতেই ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘এটি নির্বাচন নয়, উৎসব’। তারই প্রতিফলন ঘটে নির্বাচনের শুরু থেকে ফল ঘোষণা অবধি। নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার আগে নানা গুঞ্জন থাকলেও মিলিয়ে যায় তা মুহূর্তেই।
নির্বাচন কমিশন প্রার্থী ও ভোটারদের নিয়ে গত ২৭ জানুয়ারি আয়োজন করে এক ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠানের। অনুষ্ঠানে সভাপতি প্রার্থী মো. বাহাউদ্দিন গোলাপ ও মো. রফিকুল ইসলাম সেরনিয়াবাত একে অপরকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। শুধু তাই নয়, একে অপরকে মিষ্টিমুখ করান তারা। এভাবে সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী ডা. মো. তানজীন হোসেন ও আবু হাচান একে অপরকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। তারাও একে অপরের মুখে মিষ্টি তুলে দেন। এভাবেই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের দিয়ে একে অপরকে ফুলেল শুভেচ্ছা ও মিষ্টিমুখ করানো হয়। এই সৌর্হাদ্য বজায় ছিল শেষ পর্যন্ত। এটি বিশ^বিদ্যালয়ের কর্মপরিবেশ সুন্দর করতে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছে নির্বাচন কমিশন।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এস. এম. আরাফাত শাহরিয়ার, নির্বাচন কমিশনার মো. নজরুল ইসলাম হাওলাদার ও মোসা. দুলসাদ বেগম বীথির উপস্থিতিতে ২৭ জানুয়ারি ভোটারের মুখোমুখি হোন প্রার্থীরা। এতে ছিল প্রশ্ন করার সুযোগ। মতবিনিময় সভায় নির্বাচনের আচরণবিধি ও নিয়মকানুনের ঘোষণা দেন নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা। এতে রঙিন ব্যালট পেপার উন্মোচন করা হয়। এবারের নির্বাচনে প্রথমবারের মতো রঙিন ব্যালট পেপার যেমন ব্যবহার করা হয়, পুরো নির্বাচনটিই ছিল আক্ষরিক অর্থেই রঙিন।
ভোটকেন্দ্র ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের (টিএসসি) সামনের খোলা প্রান্তরে সবাই চেয়ার পেতে বসে রোদ পোহাতে পোহাতে মেতে উঠে প্রাণবন্ত আড্ডায়। মুছে যায় অতীতের সব তিক্ততা, ভেদাভেদ। সবাই মিলে দুপুরের খাবার খেয়েছেন। প্রথমবারের মতো ভোটার, প্রার্থীসহ সবার জন্য দুপুরের খাবারের আয়োজন করে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো নির্বাচন কমিশন। এটি নির্বাচন নয়, যেন বনভোজন! ভোটারকে আপ্যায়িত করে প্রভাবিত করা যাবে না, এমন নির্বাচনী আচরণবিধিতে থাকলেও বিগত দিনে তার ব্যত্যয় হতে দেখা গেছে। সবার মধ্যে হৃদ্যতা বাড়ানোর একটি উদ্যোগ হিসেবে এবং স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করে বেশি সময় ধরে ভোট নেওয়ার কারণে কমিশন দুপুরের খাবারের আয়োজন করে।
করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রথমবারের মতো ৮টি গ্রুপে ভাগ করা হয় সব ভোটারদের। এতে প্রতি গ্রুপের সর্বোচ্চ ১০ জন ভোটারের জন্য সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হয় ৩০ মিনিট করে। দুটি বুথ থাকায় প্রতি ভোটার সময় পান অন্তত ৬ মিনিট করে। গ্রুপভিত্তিক ভোটারদের সময় নির্ধারণের বিষয়টি কোনো নির্বাচনে প্রথম হলেও অনন্য এই উদ্যোগকে ইতিবাচকভাবে নেন ভোটাররা, নির্ধারিত সময়ে সুশৃঙ্খলভাবে ভোট দেন সবাই।
নির্বাচন কেন্দ্রে স্বাস্থ্যবিধি অনুসারে গোল চিহ্ন দিয়ে নির্ধারিত দূরত্বে দাঁড়ানোর স্থান চিহ্নিত করে দেওয়া হয়। যেখানে উপস্থিত ভোটাররা দাঁড়ান ও সুশৃঙ্খলভাবে ভোট দেন। কমিশন আগেই ঘোষণা করেছিলেন, ‘মাস্ক পরিহিত না থাকলে ভোট দেওয়া যাবে না। নির্বাচনী এলাকায় প্রার্থী, ভোটার বা নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কেউ মাস্ক না পরে প্রবেশ করতে পারবেন না।’ নির্বাচন কমিশন প্রার্থী, ভোটার, গণমাধ্যমকর্মী ও নির্বাচন সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকের জন্য একটি করে মাস্কের ব্যবস্থা রাখে কেন্দ্রে। ভোটকেন্দ্রে প্রবেশের পথে পর্যাপ্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও স্বাস্থ্য সরঞ্জামের ব্যবস্থা রাখে নির্বাচন কমিশন। বাইরে যেমন এর ব্যবস্থা ছিল, ভোটকেন্দ্রের অভ্যন্তরেও ছিল পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সরঞ্জামের ব্যবস্থা। ভোটের প্রচারণার ক্ষেত্রে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে বলেও জানিয়েছিল কমিশন। স্বাস্থ্যবিধি রক্ষার জন্য এসব উদ্যোগ দৃষ্টান্তমূলক ও অভূতপূর্ব বলে মত দিয়েছেন বরিশাল বিশ^বিদ্যালয়ের অনেকেই।
সামাজিক সেচ্ছাসেবী সংগঠন ইয়ুথ কগনিশনের সাধারণ সম্পাদক, গণমাধ্যমকর্মী কাজী হাফিজুর রহমান উপস্থিত থেকে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি বলেন, ‘সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশে এবং যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে নির্বাচনটি সম্পন্ন হয়েছে।’
ভোটারের গোপনীয়তা রক্ষার ক্ষেত্রে এবারের নির্বাচন দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে মত দেন সাধারণ ভোটাররা। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী ২০টি আচরণবিধির একটিতে ঘোষণা করেন, ‘ভোটারের কাছ থেকে ফোনে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিংবা সরাসরি প্রতিশ্রুতি আদায় করে সেটি রেকর্ড, স্ক্রিনশট বা অন্য কোনোভাবে সংরক্ষণ, প্রচার, প্রকাশ বা কোনো ভোটার ভোট দেবেন মর্মে প্রচার কিংবা এই ধরণের ব্যক্তিগত বিষয় প্রকাশ করা যাবে না। এ বিষয়ে অভিযোগের প্রমাণ পেলে প্রার্থী পরবর্তী সময়ে কখনোই অ্যসোসিয়েশনের কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।’
সভাপতি পদে মো. বাহাউদ্দিন গোলাপ ছাড়াও সহ-সভাপতি পদে মো. সোলায়মান খান, সাধারণ সম্পাদক আবু হাচান, সহ-সাধারণ সম্পাদক মো. জসিম উদ্দিন, সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আমিনুল ইসলাম তালুকদার, কোষাধ্যক্ষ মো. উম্মাতুল ইসলাম সিয়াম, দপ্তর সম্পাদক মো. হাসিব মিয়া, প্রচার সম্পাদক মো. আরহাম সাঈদ ও মহিলা বিষয়ক সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন মোসা. নূসরাত জাহান। সমাজকল্যাণ, সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া সম্পাদক পদে বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় নির্বাচিত হন মো. নূর ইসলাম। কার্যকরী সদস্য নির্বাচিত হন মো. মিজানুর রহমান, সাইফুল আলম ও মশিউর রহমান খান।
নবনির্বাচিত সভাপতি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রেজিস্ট্রার ও বিশিষ্ট সংগঠক মো. বাহাউদ্দিন গোলাপ বলেন, ‘বৈশ্বিক মহামারির মধ্যেও সবটুকু স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে অত্যন্ত উৎসবমুখর পরিবেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করেছেন নির্বাচন কমিশন। কমিশনের নান্দনিক ও অনন্যসাধারণ এই আয়োজন আগামী দিনগুলোতে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আমি নির্বাচন কমিশনের সকল সদস্যকে আন্তরিক ধন্যবাদ, অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানাই।’
নির্বাচনে যারা পরাজিত হয়েছেন, তারাও নির্বাচনকে সুন্দর, সুষ্ঠু ও নান্দনিক বলে মন্তব্য করেছেন, রফিকুল ইসলাম সেরনিয়াবাত নির্বাচনকে সুন্দর, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ বলে আখ্যা দেন ও এমন একটি নির্বাচন উপহার দেয়ার জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ধন্যবাদ জানান।
কে এম সানোয়ার পারভেজ লিটন বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনকে অভিনন্দন একটি সুন্দর নির্বাচন উপহার দেয়ার জন্য। হেরে গেছি দুঃখ নেই। প্রাণের সংগঠনটির সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি হয়নি, এজন্যও কমিশনের সদস্যদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।’
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রকৌশলী (সিভিল) আবু মুহম্মদ বশির বলেন, ‘সুষ্ঠ, সুন্দর ও মনোরম পরিবেশে নির্বাচন হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচনের সঙ্গে যুক্ত সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা, কৃতজ্ঞতা সুন্দরভাবে একটি নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য।’
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও নির্বাচনের প্রার্থী নুসরাত জাহান নুপুর এবং একাউন্টস অফিসার সোহেল শিকদার ও সেকশন অফিসার মো. সহিদুল ইসলাম রাকিবের সুর মিলে গেছে একখানে, তিনজনেই বলেছেন, ‘ধন্যবাদ নির্বাচন কমিশনকে, একটি সুষ্ঠু, সুন্দর নির্বাচন উপহার দেয়ার জন্য।’
টানা দ্বিতীয়বার সহ-সভাপতি পদে নির্বাচিত মো. সোলায়মান খান ‘নিখুঁত ও সৃজনশীল নির্বাচনের ব্যবস্থা করার জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ধন্যবাদ জানান। নির্বাচনটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কাভার করা গণমাধ্যমকর্মী ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শফিক মুন্সি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এস. এম. আরাফাত শাহরিয়ারের উদ্দেশ্যে মন্তব্য করেন, ‘কতটা চাপের মধ্যে দিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে আপনাকে, সেটা উপলব্ধি করার সুযোগ হয়েছে। পারিপার্শ্বিক এত জটিলতার মাঝেও নান্দনিক একটি নির্বাচন সম্পন্ন করতে পেরেছেন, এজন্য আমিও খানিকটা গর্ববোধ করছি।