বরিশালে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ৩ রোগীর অস্বাভাবিক মৃত্যু ধামাচাপা

বরিশালে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ৩ রোগীর অস্বাভাবিক মৃত্যু ধামাচাপা

বরিশালে মাদক নিরাময় কেন্দ্র হলিকেয়ারে এক যুবকের রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে। মামলা না করার শর্তে মৃতের পরিবারের সঙ্গে হলি কেয়ার কর্তৃপক্ষের দেড়লাখ টাকায় সমঝোতা হয়েছে এমন গুঞ্জন উঠেছে। এর আগেও ওই প্রতিষ্ঠানে ২ জন চিকিৎসাধীন রোগীর রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনা একইভাবে ধামাচাপা পড়েছে। চিকিৎসাধীন রোগীদের অভিযোগ, মাদক নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসার অংশ হয়ে উঠেছে ‘শারীরিক নির্যাতন’।

তবে নির্যাতনের অভিযোগ বরাবর অস্বীকার করেছে হলিকেয়ারের কর্মকর্তারা। অপরদিকে নির্যাতনের অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্ট মাদক নিরাময় কেন্দ্রের লাইসেন্স বাতিল করে দেয়ার কথা বলেছেন মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক পরিতোষ কুন্ড।

গত বৃহস্পতিবার রাতে নগরীর নবগ্রাম রোডের হলিকেয়ারে যুবকের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন কোতয়ালী মডেল থানার পরিদর্শক মো. ফয়সাল আহমেদ। 


মাদকাসক্তদের চিকিৎসার জন্য বরিশাল নগরীতে ৬টি নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে। যার অন্যতম হলিকেয়ার মাদকাসক্তি চিকিৎসা সহায়তা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র। এই কেন্দ্রে এর আগেও দুইবার নির্যাতনে চিকিৎসাধীন রোগী মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। ২০১১ সালের দিকে টিএন্ডটিতে কর্মরত উজিরপুরের গুঠিয়ার জাকির নামে এক চিকিৎসাধীন রোগীকে নির্যাতনে মৃত্যুর অভিযোগ হলিকেয়ারের বিরুদ্ধে। ২০১৫ সালেও সিএন্ডবি রোড হলিকেয়ারের শাখা থাকাবস্থায় চিকিৎসাধীন রোগী নগরীর কাঠপট্টি এলাকার পুলকের মৃত্যু হয়। তাকেও শারীরিক নির্যাতনে হত্যার অভিযোগ ওঠে তখন। দুটি মৃত্যুর ঘটনা ধামাচাপা পড়ে তাদের পরিবারের সঙ্গে হলিকেয়ারের আর্থিক সমঝোতায়। 
সব শেষ গত বৃহস্পতিবার রাতে হলিকেয়ারের নবগ্রাম রোড শাখার বাথরুম থেকে চন্দন সরকার (২৪) নামে এক যুবকের গলায় গামছা পেচানো লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। অভিযোগ রয়েছে, বৃহস্পতিবার রাতে হলিকেয়ারে নতুন রোগী আসায় চন্দনের আগের বিছানা পরিবর্তন করে বাথরুমের পাশে একটি শয্যা দেয় কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে বাদানুবাদের জের ধরে রাত দেড়টার দিকে তরিকুল নামে চিকিৎসাধীন এক রোগীকে ঘুষি দেয় চন্দন। পরে অন্যান্য ভলান্টিয়াররা চন্দনকে বেদম মারধর করে। এক পর্যায়ে তারা চন্দনকে চ্যাংদোলা করে বেঁধে রাখে। প্রায় ৩ ঘন্টা পর ওই রাতে চিকিৎসাধীন একজন রোগী বাথরুমে গিয়ে ভেন্টিলেটরের সঙ্গে গলায় গামছা পেচানো অবস্থায় চন্দনের লাশ ঝুলতে দেখে ডাক চিৎকার দেয়। খবর পেয়ে পুলিশ শুক্রবার দুপুরে তার লাশ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য মর্গে প্রেরণ করে। চন্দন গলায় ফাঁস দিয়েছে বলে দাবি করেছেন হলিকেয়ারের ইনচার্জ মাইনুল হক তমাল। তবে তাদের এই দাবি বিশ্বাস হচ্ছে না চন্দনের স্বজনদের। এ ঘটনা তদন্ত করে বিচার দাবি করেন চন্দনের মামা নিবাস মহুরী। 

ওই কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন রোগীরা গত শুক্রবার হলিকেয়ার কর্তৃপক্ষের সামনে বলেন, শারীরিক নির্যাতন এখন মাদক নিরাময় কেন্দ্রের চিকিৎসার অংশ হয়ে গেছে। পান থেকে চুন খসলেই রোগীদের কপালে জোটে শারীরিক নির্যাতন। হলিকেয়ার ভবনের পাশের বাড়ির বাসিন্দা খাইরুল হাসানের দাবি ওই সেন্টারে প্রতিদিনই নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। নির্যাতন এবং আর্তচিৎকারে আশপাশের বাসার শিশুরা আঁতকে ওঠেন বলে তিনি দাবি করেন। 


তবে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে কোন চিকিৎসাধীন রোগীকে শারীরিক নির্যাতন করা হয় না এবং শারীরিক নির্যাতন কোন চিকিৎসার অংশ নয় বলে দাবি করেন হলিকেয়ারের প্রতিষ্ঠাতা মোস্তাফিজুর রহমান সুমন। তবে সেন্টারের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে তাদের শাসন এবং কাউন্সিলিং করে স্বাভাবিক আচরণে অভ্যস্ত করা হয়। চন্দন এবং এর আগে ওই সেন্টারে দুই জনের মৃত্যু স্বাভাবিক দাবি করে সুমন বলেন, অর্থের বিনিময়ে কোন মত্যুর ঘটনা ধামাচাপা দেয়া যায় না। আইন কাউকে ছাড়ে না।

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বরিশালের অতিরিক্ত পরিচালক পরিতোষ কুন্ড গত শুক্রবার ওই কেন্দ্র পরিদর্শনকালে সাংবাকিদের বলেন, হলিকেয়ারে নির্যাতনের অভিযোগ তদন্ত করবেন তারা। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে।

এদিকে বরিশাল কোতয়ালী মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. ফয়সাল আহমেদ বলেন, চন্দনের লাশের ময়না তদন্ত এবং থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে। ময়না তদন্ত রিপোর্টে তাকে নির্যাতন কিংবা হত্যার প্রমাণ পাওয়া গেলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। চন্দনের পরিবারের সঙ্গে হলিকেয়ারের আর্থিক সমঝোতার বিষয়ে পুলিশ কিছুই জানেন না বলে দাবি করেন পুলিশ পরিদর্শক ফয়সাল।