বাউফলের মৃৎশিল্প বিশ্ববাজারে

পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার মৃৎশিল্পীদের মাটির তৈরি সামগ্রী এখন বিশ্ব বাজারে।
এখানকার পটুয়াদের নান্দনিক বৈচিত্রের শৈল্পিক সম্ভার এখন বিশ্ব বাজারের বিপনীতে ঠাঁই করে নিয়েছে। মৃৎশিল্পীদের মাটির তৈরি দৃষ্টিনন্দন বিলাস সামগ্রীর চাহিদা থাকায় ইটালি, কানাডা, অষ্ট্রোলিয়া, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, ইউকে, স্পেন, জাপান, ইউএস এ ও নিউজিল্যান্ডে রপ্তানি হচ্ছে।
এ সুসংবাদ পেয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ নিতে এ পেশা থেকে ছেড়ে যাওয়া বহু মৃৎশিল্পী (পাল) পরিবার তাদের পূর্বপুরুষের ঠিকানায় ফিরেন এসেছেন। এখন বাউফলের যে কোন পাল পাড়ায় ঢুকলেই দেখা যায় , মাটির শিল্প তৈরিতে নারী-পুরুষরা সারাক্ষণ কর্মব্যস্ত। দিন মজুরীতেও বহু নারী-পুরুষ কাজ করছেন। পালপাড়ার এমন কর্ম ব্যস্ততা দেখে মনে হয় তারা পূর্ব পুরুষের হারানো পেশাকে আবার সগৌরবে ফিরে পেয়েছেন।
এক সময় দক্ষিণাঞ্চলের পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার মদনপুরা বিলবিলাস , কনকদিয়া , বগা ও রাজনাগর এলাকায় ৫ শতাধিক পরিবার মৃৎ শিল্প পেশার সঙ্গে জড়িত ছিল। বিশেষ করে ওই সময় মদনপুরার পাল পাড়াকে মৃৎশিল্প নগরী বলা হত। তখন দেশের মৃৎশিল্পের চাহিদার একটি বিরাট অংশ অত্র এলাকা থেকে মিটানা হত। সে সময় পালেরা তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী যেমন হাড়ি, পাতিল,কলস, থালা, বাসন, জলকান্দা জালের কাঠি ইত্যাদি তৈরি করত। কিন্তু এলোমুনিয়াম, ষ্টিল, টিন , প্লাষ্টিক ও মেলামাইন সামগ্রী বাজার দখল করে নেয়ায় মাটির তৈরি জিনিসপত্র বিলুপ্তির পথে যেতে থাকে।
বিশেষ করে স্বাধীনতার পর মাটির শিল্প একেবারেই অবহেলিত অবস্থায় পড়েছিল। ফলে বহু পাল পরিবার তাদের পৈত্রিক পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় চলে যান। আবার অনেকে দেশ ত্যাগ করে ভারতেও চলে যান।
এ অবস্থায় থেকে কিভাবে বর্তমানে পালদের জীবনের মোড় ঘুরেছে, এ প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে বাউফলের প্রবীণ মৃৎশিল্পী বিশ্বেশ্বর পাল জানান, ৭০-এর দশকের শেষ দিকে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাউফল সফরকালে মৃৎশিল্পের ছোট একটি মেলা পরিদর্শন করে মুগ্ধ হন। ওই সময় এ জাতীয় মেলা ঢাকায় করার পরামর্শ দেন তিনি। তবে সারা দেশের পালদের সংগঠিত করতে বেশ কিছু সময় লেগে যায়। পরে ১৯৮৪ সালে ঢাকায় শিশু একাডেমী প্রাঙ্গনে মৃৎশিল্পের প্রথম মেলা বসে। ওই মেলায় বাউফলের মৃৎশিল্পীদের তৈরি একটি ষ্টল স্থান পায়। এরপর মৃৎশিল্পকে রক্ষায় এগিয়ে আসে চারুকলা ইনষ্টিটিউটের কিছু উদ্যোগী ছাত্র এবং বিসিক। এরপর তাদের আর পিছনের দিকে তাকাতে হয়নি।
তিনি আরও বলেন, বাউফলের মৃৎশিল্পীদের আধুনিকীকরণের লক্ষ্যে এগিয়ে এসেছে বেসরকারি সংস্থা স্পিড ট্রাস্ট। ওই সংস্থা ইতিমধ্যে ৩০০ পালকে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর প্রশিক্ষণ দিয়েছে। তারা বিনামূল্যে হুইল প্যাড ও বৈদ্যাতিক চুল্লি সরবরাহ করেছেন। বিদেশী ক্যাটালগ দেখে সময়োপযোগী করে নতুন ডাইস, রং বার্নিসে মৃৎশিল্পের আকার ও সাজ শোভা পরিবর্তন করা হয়। ক্রমাগত এর চাহিদা বাড়তে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে বিদেশে রপ্তানির বাজার সৃষ্টি হয়।
বাউফলের মদনপুরার পাল পড়ার প্রবীন মৃৎশিল্পী রাজ্যশ্বর জানান, তাদের পৈত্রিক পেশা যখন বিলুপ্তির পথে তখন তারা কোন উপয়ান্ত না পেয়ে মাটি দ্বারা ফুলের টব, খেলনা এবং বিভিন্ন জীব জানোয়ারের ছবি, মণীষীদের ছবি বানিয়ে বৈশাখী মেলায় বিক্রি করত। এমনকি বরিশাল শহরে গিয়ে অশি^নী কুমার হলের সামনে ফুটপাতে বসে বিক্রি করেছেন।
ঐতিহ্যবাহী এই মৃৎশিল্পীরা জানান, বাউফলের মৃৎশিল্পীদের দুঃখ-কষ্টের জীবন এখন আর নেই। তাদের জীবন জীবিকার মোড় বদলে গেছে। তারা বর্তমান যুগের রুচি ও চাহিদা অনুযায়ী ঘর ও ঘরের ড্রইং রুম সাজানোর জন্য নিত্য নতুন ডিজাইনের বিলাসসামগ্রী তৈরি করে থাকেন। তাদের তৈরি বিলাস সামগ্রী ঢাকার আড়ং , হীড বাংলাদেশ, কোর দ্যাজুট ওয়ার্কস ও ঢাকার হ্যান্ডিক্রাফটস এ সরবরাহ করা হয়। ওইসমস্ত সংস্থা থেকে বিদেশে রপ্তানি করা হয়। বাউফলের মৃৎশিল্পীরা রং ও ডিজাইন হাতে করে থাকে। তাদের রং ওডিজাইন অপূর্ব। বর্তমানে বাউফলের মদনপুরা, বিলবিলাস , কনকদিয়া, কাগজেরপুল ও বগা পালপাড়া থেকে প্রতিদিন লঞ্চ ও বাস, ট্রাকযোগে তাদের উৎপাদিত পণ্য ঢাকাসহ সারাদেশে পাঠানো হয়।