ভোরের সূর্য আবার ছুটবে আমাদের নিয়ে

ভোরের সূর্য আবার ছুটবে আমাদের নিয়ে

একটা বছর ফের চলে গেল। ভোরের যে সূর্য আলো ছড়াবে, সে আবার ছুটবে আমাদের নিয়ে। ছুটবে নানা ঘটনার বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে। যে ঘটনা প্রবাহ কখনো করবে আনন্দিত, উদ্বেলিত উচ্চ করবে শির। কখনো দারুন বিস্ময় ভরা হতাশায় মিশিয়ে দেবে মন একেবারে মাটির সাথে। এইতো নিয়ম কালের যাত্রার। অনন্তকাল ধরে সে চলে এসেছে চলবেও সে অনাদীকাল ধরে একই ধারায়। কেবল আমরা তার খেলার সাথী কিংবা উপকরণ। যে খেলা দেখে দেখে বলতে বাধ্য হই কখনো ভালো কখনো মন্দ। কথনো পছন্দের কখনো তা অপছন্দ। কখনো সে ঠিক কখনো সে একেবারেই ভুল। যে কারণে স্বভাব বসত কখনো কারো মুখে উচ্চারিত হয়ে ওঠে ‘লজ্জা সরম বলি জাননাকো কিছু, উন্নত করিছ শির যার মাথা নিচু!’ এমন কিছু অসামঞ্জস্যতার জন্য পৃথিবীও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। যেমনটা শেষ পর্যন্ত হতেই হলো রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে। আমরা দেখতে বুঝতে বাধ্য হলাম শান্তির ধ্বজাধারীর সাম্রজ্যবাদী রূপ। করোনা আজও পথ ছাড়েনি পৃথিবীর। ইউক্রেন ও তাইওয়ান নিয়ে পুরো বছর জুড়েই অস্ত্র বিক্রির ফাঁদ পেতে বসে আছে আমিরিকা। যাকে যুদ্ধ বলি আমরা।

বছর শেষে খেলার জগত মাতিয়ে স্মরণযোগ্য করে রেখেছিল কাতার ফুটবল বিশ্বকাপ। সেই ফুটবলেরই বিস্ময় মানুষ ভূবন বিখ্যাত খেলোয়াড় ব্রাজিলের কালো মানিক পেলের প্রয়াণের খবরটা খুবই দু:খের। একই সাথে বছরের মাঝামাঝি চলে গেলেন বৃটেনের রাণী। প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হলো জাপানের প্রধান মন্ত্রীকে। রাজপথে গুলি বিদ্ধ হলেন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। এ বছর দেশের জন্য সবচেয়ে উদ্বেগের কারণ ছিল মিয়ানমারের ছোড়া গোলার বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রম। বছর শেষে বেড়েছে সরকারের উপর আরো বেশি গণতান্ত্রিক হবার দেশি বিদেশী চাপ। স্মরণকালের সবথেকে বেশি মুদ্রাস্ফীতির চাপে রয়েছে দেশ। জ্বালানী তেলের ছিল অবিশ্বাস্য মূল্য বৃদ্ধি। ছিলো দেশ স্বাধীনের পর সর্বশেষ্ঠ অর্জন পদ্মাসেতুর আর মেট্রোরেলের মহা উদ্বোধনর মতো বিস্ময়। সেই সাথে আছে দক্ষিণের জনপদের দুইটি সেতু যথাক্রমে পায়রায় লেবুখালি এবং বেকুটিয়ার দ্বার উন্মোচন। আছে এমন আরো অসংখ্য অজ¯্র ঘটনা প্রবাহ। যিনি বা যারা সালতামামী লিখবেন নিশ্চয়ই তাদের হাতে তার পূর্ণতা মিলবে।

সেই সকল ঘটে যওয়া ঘঠনার একটি ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে ছোট্ট একটু কথা হতে পারে। আমাদের নিশ্চয়ই স্মরণে আছে গত ৯/১০/২০২২ তারিখ পালিত হলো ঈদে মিলাদুন্নবী। বিশ্বের সকল মুসলিম সম্প্রদায় আত্যন্ত তাজিমের সাথে পালন করেছে তাদের ধর্মীয় রীতি নীতিতে। ঠিক সেই একই দিনে পালিত হলো সনাতন ধর্মাবলম্বী বা হিন্দু সম্প্রদায়ের লক্ষী পূজা। হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরে ঘরে চলেছে লক্ষীদেবীর আরাধনা। একই সাথে ধর্মীয় পবিত্রতায় পালন করছে বৌদ্ধ সম্প্রদায়। তাদের প্রবারণা পূর্ণিমা। খুবই ভালো হতো ইস্টার সানডেও যদি ঐ দিনই  হতো। তার পরেও আমি ঠিক জানি না এই পৃথিবীতে এমন একটি দিন আর কবে এসেছিল, ফের আবার কবে আসবে? যেখানে আসিয়া একাধিক ধর্ম পালনের ভিন্ন ধারার রূপ উদ্যাপিত হলো যার যার মতো করে একই দিনে। কোন ব্যাত্যয়তো হলো না কোথাও? মানুষ এভাবেই তার নিজস্বতা বজায় রেখে চলবে। সেই তো স্বাভাবিক।

এক আকশে উড়বে মন্দিরের পূজার শুদ্ধ ধোয়া, মিলাবে পবিত্র আজানের ধ্বনি, প্রভারণায় উড়ানো ফানুষ। আকাশ বিশাল অনিয়ন্ত্রিত, তাই তাকে ভাগ করতে পারি না আমরা। ভাগ করতে পারে না কোন ধর্ম বিচার। মা আর মাটিকে মনে করি এখানে আমাদের অনেক অস্তিত্ব। তাই তাকে ছোট করি পদে পদে। কারণে অকারণে। করি বিভাজন কর্মে, পদ্ধতিতে, ধর্মের গোড়ামিতে। অথচ যা সত্য নয় প্রয়োজনীয় নয়। কেবল যার ভিতরে থাকে স¦ার্থ হাসিলের অযোগ্য অসভ্য অসুন্দর। আর সুন্দরের নামে অসুন্দর উপকরণ।

আজ বোধ করি কেউ পড়বে না এই লেখা। পড়লেও গন্ধ খুঁজবে সম্প্রদায়িকতার। তার পরেও আমি লিখলাম। হাফেজ তাকরিম একটি আন্তর্জাতিক পুরুষ্কারে ভুষিত হয়েছে এ বছর। তাকে মোবারকবাদ জানাই। তার সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনা করি। পৃথিবীর অনেক দেশের সাথে বাংলাদেশের নামকে সমুন্নত রেখেছে সে। বয়সে অতন্ত ছোট। শুধু স্মীয় অনুশীলন, একাগ্রতা আর তার শিক্ষকদের যথার্থ দিক নির্দেশনা এবং সেই সাথে মহান আল্লার অপার সহানুভুতির জন্যই তার এই অর্জন। মহান আল্লাহ তার কণ্ঠে রহমতের সুর দিয়েছেন। যে সুরে কোরআনের মহা পবিত্র বাণীর যুগলবন্দি তাকে এনে দিয়েছে এমন সম্মান। এই সম্মান তার। এই সম্মান তার শিক্ষাগুরুদের এবং এই সম্মান কোরআন মাজিদের। আর এই যোগ্যতা অর্জনকারীর প্রতি নিশ্চয়ই আমাদের প্রার্থনা। আল্লাহ্ যেন তোমাকে ইসলামের সঠিক পথ অনুশীলণের মাধ্যমে, আল্লার মহা পবিত্র ধর্মীয় বাণীর একজন উজ্জ্বল খাদেম হিসাবে বিশ্বের বুকে স্থান দান করেন। তোমার দ্বারা বাংলাদেশের নাম রওশান করেন। 

এখন সময়টা বিশ্ব মিডিয়ার। যার সাথে সম্পৃক্ত আছে বিশ্বমানের শয়তানদের সকল হাত। সেখানের একটি প্রশ্ন বলছে। যদি দেখে থাকেন কেউ, যদি চোখে পড়ে থাকে কারো, যদি বুঝে থাকি এই ছবি এবং তার নিচে লেখা প্রশ্ন। তবে উচিত আমাদের তার উত্তর প্রদান। সুন্দরের কথা বলে যারা অনবরত অসুন্দর তৈরি করে। এই মানুষ এবং তাদের অসুন্দর বুদ্ধির বিরোধীতা, প্রতিরোধ প্রয়োজন। নয়তো সকল কিছুকে অসুন্দর করে তুলবে। আজ মনে হচ্ছে এ তুচ্ছ অগ্রহণযোগ্য। সেদিন দূরে নয়, যখন দেখবো এই অসুন্দরের সাথে সন্ধির কি বিভৎস অন্ধকার ফলাফল!

এখন বলি, বিশ্ব মিডিয়ায় কি ছিল সেই ছবি এবং প্রশ্ন? ছিল দুইটি ছবি পাশাপাশি অবস্থান। প্রশ্ন ছিল বলুনতো কোনটা সুন্দর? প্রথম ছবিটটি ছিল সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন বাংলদেশ নারী ফুটবল দলের সতঃস্ফূর্ত গণ সংবর্ধনার। এয়ারর্পোট থেকে ছিল যার শুরু। দ্বিতীয়টা ছিলো সৌদিতে পবিত্র কোরআন তেলওয়াত প্রতিযোগিতায় তাকরিমের ১১১টি দেশকে পিছনে ফেলে তৃতীয় স্থান অধিকার করায়, তাকেও বিমান বন্দরে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান তার সহযাত্রী ও সমমনা মানুষেরা। দুটোই প্রশংসার দাবী রাখে। দুটো অর্জনই দেশের জন্য। একটি নিতান্তই ব্যক্তির যোগ্যতার। আর একটি রাষ্ট্রের সমষ্টির। এই দুটি অর্জন বা দুটি বিজয়ের উল্লাস কি একই রূপের হওয়ার কথা? হতে পারে, সেটা গ্রহণযোগ্য হতো সবার কাছে?

যে মাঠে ফুটবল খেলা হয়েছে নিশ্চয়ই সেখানে মুহুর্মুহু ধ্বণিত হয়েছে বাংলাদেশ বাংলাদেশ শব্দ উল্লাস? সেখানে বারবার করতালিতে প্রকম্পিত হয়েছে মাঠ। আতসবাজী প্রজ্জলনে আলোকিত হয়েছে আকাশ। সেই একই আনন্দ উল্লাস কী করা সম্ভব ছিল তাকরীমের কোরআন তেলাওয়াত করে তৃতীয় স্থান অর্জনের পর? সেটা কি ভালো হতো? করা যেতো, সেটাকি প্রাসঙ্গিক হতো এই প্রাপ্তির সাথে, ধিক্কার উঠতো না দেশ জুড়ে? ওর যা বয়স ওকে আরো সুন্দর গাইড দেওয়া গেলে অদূর ভবিষ্যতে কোরআনের আলোকিত বাণী ওর কন্ঠে আরো সুমধুর হয়ে বিশ্ব তেলাওয়াতে কোরআনে নিজের অবস্থা আরো সুদৃঢ় করতে সক্ষম হবে। সেই আহ্বান রাখা খুব জরুরী।

দেশের নারী ফুটবলারদের বিজয়ের সাথে তাকরীমের বিজয়কে মিলিয়ে যেনতেন ভাবে বিষয়টাকে জটিল করবার এই প্রয়াশটি মোটেই ভালো ছিলো না। ফুটবলের বিজয় মানে দেশের আপামর জনসাধারণের বিজয়। সকল ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের মানুষদের বিজয় এবং  স্ববিশেষ দেশের বিজয়। সুতরাং, আমি  বলবো  নিশ্চয়ই এ দুটোই অসীম সুন্দর, শুধু এখানে অসুন্দর ঐ ছবি দুটোর মাঝের প্রশ্নটা, ‘বলুন তো কোনটা সুন্দর?’ শুধু এই প্রশ্নকর্তা আর তার প্রশ্ন বাদে বাকি সব কিছুই ছিল সঠিক এবং সুন্দর। সুন্দর সাফ নারী ফুটবলের বিজয়, সুন্দর তাকরিমেরও বিজয়। দুই বিজয়েই উচ্চরিত হয়েছে বাংলাদেশের নাম। কেবল ভিন্নতা হয়তো বিমান বন্দরে তাকরিমের আগমনে সেখানে ধ্বণিত হয়েছে ‘নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবার। আর নারীদের বিজয়ী বেশে ফেরার পথে পথে ধ্বণিত হয়েছে ‘জয় বাংলা’ ধ্বণি।

এর কোনটাই কি পরিবর্তনযোগ্য? করা যায়, উচিত কি? সুতরাং সুন্দরের খোঁজ কোন অসুন্দর কিংবা অযৌক্তিকতা দিয়ে নয়। সুন্দরকে চিন্তায়, মননে, স্বপ্নে এবং বাস্তবে জায়গা দিয়ে সমৃদ্ধ করতে হয় দেশ। তখনই সমৃদ্ধ হবে দেশের মানুষ, হবে সুন্দর মন ও রূপের অধিকারী। অসুন্দর প্রশ্ন করে তাতে বিদ্বেষ ছড়ানো বিভক্তি ছড়ানো কোন সুস্থতা নয়। না সাংস্কৃতিক, না সামাজিক, না রাজনৈতিক, না ধর্মীয়। এ কোন সুস্থ্য আচরণ নয়।  কোন শ্রেষ্ঠত্ব জাহিরের প্রতিযোগিতাতেও এর কোনটার উপস্থিতি প্রাসঙ্গিক নয়। সকল উৎসব আনন্দ বিজয়ে আনন্দিত হতে পারাটা খুব জরুরী। সেখানেই আমাদের সুস্থ্য সুন্দর মন ও মস্তিষ্কের পরিচয় নিহিত আছে, থাকবে। ২০২৩ এই ইংরেজি বছরটা শান্ত, শান্তিময় থাকুক প্রাণ, প্রাণি, প্রকৃতি, আলো, পানি, বায়ু এবং মানুষ সবার জন্য। জাতির জীবন থেকে স্খলিত হোক হিংসা, দ্বেষ ও লোভ। সর্বজনীন হোক সুস্থ্যতা। শুভ নববর্ষ।
লেখক: আজমল হোসেন লাবু, বাচিক শিল্পী ও বাংরাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সভাপতিম-লীর সদস্য।