লকডাউনে কর্মহীন শ্রমজীবী মানুষের দুর্ভোগ

করোনা বৈশি^ক সমস্যা। গোটা দুনিয়ায় মহামারী আকার ধারণ করেছে। যার প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিসহ জনজীবনের সর্বত্র। একদিকে করোনায় যেমন মৃত্যুর মিছিল বাড়ছে, তেমনি জ্যামিতিক হারে মানুষের কর্মহীন হওয়া এবং কাজ হারানোর ঝুঁকিও বাড়াচ্ছে। তাই স্বাস্থ্যবিধি মানতে পারছে না তারা। তাদের দাবি, ‘আগে খাবার, তারপর স্বাস্থ্যবিধি’। মারা যাবার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত খাবার ছাড়া চলে না। তাই লকডাউনের আগে কর্মহীন এবং শ্রমজীবী মানুষের খাবার নিশ্চয়তা চান তারা। তাদের কাজ না থাকায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। তাদের বক্তব্য এমন ‘মরার আগ পর্যন্ত তো খাবার দরকার’, সেটা কে দেবে। তাইতো মানুষকে যতো ঘরে থাকতে বলা হচ্ছে ততোই রাস্তাঘাট, হাট-বাজারে বাড়ছে ভীড় বাড়ছে। লকডাউন দিয়েও মানুষ ঘরে রাখা যাচ্ছে না। এই সময়ে কেউ কেউ হয়তো নানা অজুহাতে বের হচ্ছেন। তবে বেশিরভাগ বের হচ্ছেন কর্মহীন মানুষ। তাদের পাশে সহযোগী হতে উদ্যোগ নিন।
দেশে দিন দিন করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। বাড়ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকিও। সরকার এবং স্বাস্থ্য বিভাগ নাগরিকদের সচেতন করতে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করছে। যা অব্যাহত আছে। সরকারের সিদ্ধান্তে লকডাউন কার্যকরে উদ্যোগ একান্তই প্রাসঙ্গিক। কিন্তু লকডাউনের কারণে নি¤œ আয়ের শ্রমজীবী কর্মহীন মানুষ চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। তাদের এই বিপর্যয় থেকেও মুক্তি দিতে হবে। লকডাউনে কর্মহীন শ্রমজীবী মানুষের চরম দুর্ভোগে তাদের পাশে সহযোগী হওয়া একান্ত আবশ্যক। এসব মানুষদের আশ^স্ত করে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হলে করোনা মোকাবেলা করা আরও কঠিন হবে।
করোনায় দেশে কর্মহীনদের মধ্যে যেমন রয়েছে দিনমজুর, লঞ্চ, বাস, ট্রাক শ্রমিক, দোকান শ্রমিক, তেমনি আছে বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা (এমপিওভুক্ত নয়), অর্থের বিনিময় শিক্ষা দেওয়া প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরাও। এদের মধ্যে দিনমজুর, রিকশা-ভ্যান চালকরা রাস্তায় বের হয়ে কাজের চেষ্টা করলেও বাকিরা আত্মসম্মানের ভয়ে রাস্তায়ও বের হতে পারছেন না। কারো কাছে চাইতেও পারছেন না। এই কঠিন সময়ে তাদের সহযোগী হওয়া একান্ত জরুরী।
একদিকে কর্মহীন মানুষের আহাজারী আর একদিকে রমজানের সিয়াম সাধন। কে কার সিয়াম সাধন করবে বোঝা যাচ্ছে না। সব বন্ধ। করোনার সঙ্গে রমজান শুরু হওয়া এবং লকডাউনের অজুহাতে নিত্যপন্য আকাশ ছোঁয়া। চালের দাম ৫০ ছাড়িয়ে ৭০ টাকায় ঠেকেছে। কাজ না থাকা, তার ওপর বাজারের উর্ধ্বগতিতে কর্মহীন শ্রমজীবী মানুষ নির্বাক হয়ে গেছে।
করোনার কারণে নানা পেশার মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। বেসরকারি অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে যারা সরকারের এমপিওভুক্ত নয়, কেবল শিক্ষার্থীদের বেতনে চলে। সেসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের অবস্থা ব্যাখ্যা করা কঠিন। তাদের বেতন যেমন বন্ধ আছে তেমনি কারো কাছে বলতেও পারছে না। তাই কাজের সন্ধানে বাইরে যাবার এক ধরণের তাড়না তৈরি হয়েছে। করোনায় আক্রান্তের ভয়ের চেয়েও তাদের কাছে বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে খাবার সংগ্রহ। তাই মনে হচ্ছে এক ধরণের অসুস্থ্য প্রতিযোগিতা।
গত বছর করোনা শুরুর পর থেকে সরকার নানাভাবে কর্মহীন মানুষের সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছিল। চাল-ডালসহ নিত্য পন্য যেমন দিয়েছে তেমনি অর্থনৈতিক সহযোগিতাও দিয়েছে। এর সঙ্গে নতুন করে রেশনিং ব্যবস্থার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ, সেনাবাহিনী ছাড়াও নানা ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান খাদ্য সহায়তা নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়েছে। এবছর করোনর প্রভাব ১০ গুণ বেশি। যার ফলে লকডাউন দিয়ে সরকার করোনা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। কিন্তু এই সময়ে খাদ্য ও অন্যান্য সহযোগিতা পাচ্ছে না কর্মহীন মানুষ। এখন মানুষের দাবি কাজ ও খাবারের নিশ্চয়তা। লকডাউন মানাতে হলে ঘরে ঘরে খাবারের নিশ্চয়তা দিতে হবে।
লকডাউনে শ্রমজীবী মানুষের জন্য অর্থ বরাদ্দ ও রেশনিংয়ের দাবিতে বরিশালে রিক্সা মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই মিছিল থেকে শ্রমজীবী মানুষরা দাবি জানায়, শ্রমিকদের ত্রাণ না দিয়ে লকডাউন কার্যকর করা সম্ভব নয়। এক মাসের চাল-ডাল এবং কমপক্ষে ৫ হাজার টাকা করে শ্রমিক পরিবারের হাতে তুলে দিয়ে তারপর লকডাউন কার্যকর করার দাবি জানান তারা। শ্রমিকদের অযথা হয়রানী করে এর সমাধান হবে না। শ্রমিকদের জন্য অবিলম্বে ত্রাণ ও রেশনিং চালু করার জোর দাবিও তোলেন তারা।
বরিশাল নদী বন্দরের কর্মহীন লঞ্চে মানুষ ডেকে তোলা শ্রমিকরা আহাজারী করছে। লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকায় তারা বিপাকে পড়েছেন। লঞ্চ কর্তৃপক্ষও তাদের সহযোগী হচ্ছেন না। গত বছর দুই দফায় তারা জেলা প্রশাসন থেকে খাদ্য সহায়তা পেয়েছিলেন। এবছর সেই সহযোগিতার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন তারা। একই অবস্থা নদীবন্দর কেন্দ্রীক ভ্যান চালকরাও। তাদেরও সহযোগিতা দিয়েছিল জেলা প্রশাসন। সহযোগিতা পেয়েছিল সংবাদপত্র বিক্রয় কর্মীরাও। এমন অনেক পেশার মানুষ কাজ না থাকায় অসহায় হয়ে পড়েছেন। এসব দিনমজুর কর্মজীন শ্রমিকরা নানা অজুহাতে কখনো রিকশা, কখনো অন্য কোন কাজ নিয়ে রাস্তায় বের হচ্ছেন। করোনা মহামারী নিয়ন্ত্রণে সরকারের সকল উদ্যোগের সঙ্গে কর্মহীন শ্রমিকদের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া দরকার।
বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে দেশের ৬০ থেকে ৭০ ভাগ মানুষ আর্থিক এবং খাদ্য সংকটের মধ্যে আছে। মাত্র ৫ কোটি মানুষের খাদ্য ও আর্থিক নিশ্চয়তা আছে। বাকি ১৩ কোটি মানুষের কম-বেশি খাদ্য, কাজ ও আর্থিক সংকট আছে। যদি তা ও না হয় মোট জনসংখ্যার অর্ধেক হলেও ৯ কোটি মানুষের খাদ্য সহায়তা একান্ত দরকার। তাদের খাবার ও কাজের নিশ্চয়তা না থাকলে কোন নিয়ম কি তারা মানতে পারবে? সেই বষয়টি খতিয়ে দেখা একান্ত জরুরী।
এমন বাস্তবতার পরও বলতে হচ্ছে করোনা যেভাবে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে সচেতনতার কোন বিকল্প নেই। জরুরী স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। এক্ষেত্রে লকডাউন মানতে অবশ্য অবশ্যই কঠোরও হওয়া দরকার। সেই সঙ্গে কর্মহীন শ্রমজীবী মানুষের দুর্ভোগ লাঘব করতে জরুরী পদক্ষেপও নিতে হবে।