আজকের প্রজন্ম রুমু। ওদের চোখে মুক্তিযুদ্ধ কেবল ইতিহাস। রুমুরা নানু, কিংবা মায়েদের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শুনে শুনে বেড়ে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন নিয়ে তারা সামনে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু রুমুদের আগের প্রজন্ম কিংবা তারও এক প্রজন্মের আগের মানুষের কাছে মুক্তিযুদ্ধ তো জীবন্ত উপখ্যান। যদিও সে উপখ্যান অনেকটা ফিকে হয়ে আসছে। নতুন করে সেই অন্ধকারে আলো ফেলে সামনে তুলে এনেছে শব্দাবলীর নতুন নাটক বৈশাখিনী। বৈশাখিনী-ই বাংলাদেশ।
মুক্তিযুদ্ধে কেউ সন্তান হারিয়েছে। কেউ পাকিস্তানীদের নির্যাতনে মৃত্যু বরণ করেছে। কিন্তু পাকিস্তানীদের লালসার শিকার হয়ে আজন্ম যন্ত্রণা বয়ে বেরিয়েছে কজন নারী। যুদ্ধ শিশু হওয়ার যন্ত্রণা যে নারী বয়ে নিয়ে চলেছেন তার কথা ক’জন জানি আমরা? যদিও বা জানি তাকে নেতিবাচক হিসেবে এখনো উপস্থাপন করতে উদ্যত হই। যে নারী ও শিশু আজো অসহ্য সেই যন্ত্রণা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করে চলেছে। সেই যন্ত্রণা এক প্রজন্ম থেকে চতুর্থ প্রজন্ম পর্যন্ত ঠেকেছে। সেই প্রজন্মের প্রতিচ্ছবি-ই আজকের রুমু।
শব্দাবলী গ্রুপ থিয়েটারের স্টুডিও থিয়েটার মঞ্চে বৈশাখিনী নাটকের ২৫তম প্রযোজনা দর্শকদের একাত্তরের বীরাঙ্গনা, এক নারী যোদ্ধার বাস্তব কাহিনীর সামনে হাজির করিয়ে দিয়েছে। যে বীরাঙ্গনার যুদ্ধ করতে হয়েছে ঘরে এবং বাইরে। ঘরে রাজার স্বামীর বিরুদ্ধে। আর বাইরে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে। এই নাটকের মাধ্যমে এক পরিবারের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এবং বিপক্ষের চিত্র ফুটে উঠেছে।
রুমুর নানু নিভৃতে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযাগিতা করে চলতো তাঁর স্বামীর অগোচরে। কারণ স্বামী ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধের মানুষ। স্বামী খান বাহাদুর বাংলাদেশ বিরোধী হিসেবে পাকিস্তানীদের সহযোগিতা করতো। সেই পাকিস্তানীরাই খান বাহাদুরের একমাত্র কন্যাকে ধরে নিয়ে পাশবিক অত্যাচার করে। পাকিস্তানীদের মদদ দেওয়া খান বাহাদুর সেদিন তাঁর কন্যাকে রক্ষা করতে পারেননি। তাঁর কন্যা জন্ম দেন যুদ্ধ শিশু। সেই যুদ্ধ শিশুর সন্তান বর্তমান প্রজন্ম রুমু। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চার প্রজন্ম বয়ে চলা কাহিনী-ই আমাদের বাংলাদেশ। এই কাহিনী আমাদের লাল-সবুজের পতাকা।
শব্দাবলীর নাটক বৈশাখিনীর চার প্রজন্মের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরতে গিয়ে অভিনেতারা বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। বিপরিতমূখী চরিত্রে অভিনয় করে তন্দ্র মল্লিক, সোনিয়া আক্তার, মনি আক্তার এবং সুরভী জাহান নিশি দর্শকদের মুগ্ধ করেছেন। রুমু চরিত্রে তন্দ্রা মল্লিক একদিকে বর্তমান প্রজন্ম এবং একই সঙ্গে বিপরীতধর্মী চরিত্র খান বাহাদুরের চরিত্রে অভিনয় করার যে যোগ্যতা দেখিয়েছে সেটা কেবল অনুশীলনের কারণেই সম্ভব হয়েছে। এর বাইরে শাহজাদী, মোক্তার ও খান বাহাদুরের চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে সোনিয়া আক্তারের প্রচেষ্টাও দাগ কেটেছে। আর সুরভী জাহান নিশির জেসমিন ও মোক্তারের ভূমিকায় অভিনয়ও প্রাণবন্ত হয়েছে।
মঞ্চে এই প্রজন্মের কম বয়সী চার অভিনেত্রী নিঃসন্দেহে তাঁদের শ্রেষ্ঠটা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। নাটকের টীমওয়ার্ক, সংগীত পরিচালনায়ও ব্যতিক্রমী ছাপ ছিল। পোশাক বিন্যাসেও নান্দিনিকতার ছোঁয়া ছিল। আলো ও শব্দের সম্মিলন ঘটেছে নিখুঁতভাবে। তবে নাটকের বেশ কয়েক জায়গায় উচ্চারণে ত্রুটি কানে লেগেছে। এ ছাড়া খান বাহাদুরের কোন কোন মুহূর্ত এবং নূরজাহানের অভিব্যক্তির আরও দৃঢ় হতে পারতো বলে মনে হয়েছে। ক্ষুদ্র এই বিষয়গুলোর প্রতি আরো একটু দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে। সবমিলে অসাধারণ মঞ্চায়ন বৈশাখিনী।