শহীদ আলতাফ মাহমুদ পদক পাচ্ছেন যারা

শহীদ আলতাফ মাহমুদ পদক পাচ্ছেন যারা

বাংলাদেশের সঙ্গীতের অমর সুরস্রষ্টা শহীদ আলতাফ মাহমুদ এক অনুপ্রেরণার নাম। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট বাংলার এই অকুতভয় সূর্যসন্তানকে তুলে নিয়ে যায়। তার আর কোনো খোঁজ মিলেনি। সশরীরে জাতি আর তাকে ফিরে না পেলেও তিনি রয়ে গেছেন এ দেশের ইতিহাসে। প্রতিটি দেশপ্রেমী বাঙালির মর্মে-মননে তার সুরে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি’ দীপ্তময় হয়ে তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে অনির্বাণ করে।
জাতীর এই অগ্নিসন্তানের অন্তর্ধান দিবসে এবার তার নামাঙ্কিত পদক প্রদান করে সম্মাননা জানানো হবে সংস্কৃতি অঙ্গনের তিন বরেণ্য ব্যক্তিত্বকে। তারা হলেন- প্রবীণ সাংবাদিক ও সংগঠক কামাল লোহানী এবং রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধের দুই স্থপতি ফরিদ উদ্দিন আহমেদ ও জামী আল সাফীকে।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গীত ও নৃত্যকলা মিলনায়তনে আগামী ৩০ আগস্ট শুক্রবার এই পদক প্রদান করা হবে। সেদিন বিকেল ৫টায় শুরু হবে আয়োজনটি। আলতাফ মাহমুদ ফাউন্ডেশনের আয়োজনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। 
এ ছাড়াও থাকবেন বিভিন্ন অঙ্গনের আরও অনেক প্রিয়মুখ।
আলতাফ মাহমুদ একজন ভাষা সৈনিক, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও সুরস্রষ্টা। বাংলাদেশি সত্ত্বায় প্রথম যে গানটি স্ফুলন দিয়েছিল তা হলো, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’। শুধু কী ভাষা আন্দোলনের চিত্রধারণ? এ গানটি প্রেরণা হয়ে আছে ১৯৫৪, ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৬৬৯ ও মহান একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে।
আর যার সুরে এ গানটি প্রাণ পায়, তিনি সুরস্রষ্টা শহীদ আলতাফ মাহমুদ। তার অসংখ্য গানগুলোর মধ্যে এ গানটি তাই ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। শুধু সুর আর গানেই নয়, এ মহানের কীর্তি আছে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনেও। মুক্তিযুদ্ধে সংগঠক ও গেরিলাযোদ্ধা হিসেবে তার অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৩৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর বরিশাল জেলার মুলাদী উপজেলার পাতারচর গ্রামে আলতাফ মাহমুদ জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালে বরিশাল জিলা স্কুল থেকে কোলকাতা বোর্ডের পরীক্ষা আন্ট্রান্স (এস এস সি) পাস ও ব্রজমোহন কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে (আইচ এস সি) ভর্তি হন।
পরে তিনি চিত্রকলা শিখতে ক্যালকাটা আর্টস স্কুলে যান। বিদ্যালয়ে থাকা অবস্থায়ই এ শিল্পী নিয়মিত গাইতেন। প্রসিদ্ধ ভায়োলিন বাদক সুরেন রায়ের কাছে প্রথম সংগীতে তালিম নেন। তবে জনগণের কাছে তিনি প্রিয় ও পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন গণসংগীতের মাধ্যমে। এর মাধ্যমেই তখন চারদিকে তার নাম ও খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি সারা আরা মাহমুদকে বিয়ে করেন। তাদের সন্তানের নাম শাওন মাহমুদ।
১৯৫০ সালে আলতাফ মাহমুদ ঢাকায় ধূমকেতু শিল্পী সংঘে যোগ দেন। পরবর্তীকালে তিনি এই সংস্থাটির 'সংগীত পরিচালক' পদে আসীন হন। সেসময়ই তিনি ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য বিভিন্ন জায়গায় গণসংগীত গাইতেন। গান গাওয়ার মাধ্যমে আলতাফ মাহমুদ এই আন্দোলনকে সর্বদাই সমর্থন যুগিয়েছেন।
১৯৫৩ সালে প্রখ্যাত সাংবাদিক আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে য়োরি’-তে নতুন করে সুর করেন আলতাফ মাহমুদ। তিনবার এ কাজটি করার পর নতুন সুর চূড়ান্ত করেন। গানটির প্রথম সুর করেছিলেন আব্দুল লতিফ। তাকে আলতাফ মাহমুদ নতুন সুরটি শোনান। তিনি বেশ প্রশংসা করেন নবরূপের এ গানটি।
১৯৫৪ সালে ‘ভিয়েনা শান্তি সম্মেলনে’ মাহমুদ আমন্ত্রিত হন, কিন্তু করাচিতে পাকিস্তানি সরকার তার পাসপোর্ট আটকে দেওয়ায় তিনি এখানে যোগ দিতে পারেননি। তিনি ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত করাচিতে ছিলেন এবং ওস্তাদ আব্দুল কাদের খাঁ’র কাছে উচ্চাঙ্গসঙ্গীত বিষয়ক তালিম নিয়েছিলেন। ১৯৫৬ সালে আলতাফ মাহমুদ করাচি বেতারে প্রথম সঙ্গীত পরিবেশন করেন। তিনি ‘ইত্তেহাদে ম্যুসিকি’ নামে দশ মিনিটের একটি অনুষ্ঠান প্রযোজনা ও পরিচালনা করতেন।
তার গানে বৈচিত্র্যতা আরও স্পষ্ট বোঝা যায়, ব্যস্ততার মাঝেও চলচ্চিত্রে ব্যাপক পরিসরে কাজ করায়। করাচি থেকে ঢাকা ফেরার পর আলতাফ মাহমুদ ১৯টি চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন। এরমধ্যে বিখ্যাত চলচ্চিত্রগুলো হলো- জীবন থেকে নেয়া, ক্যায়সে কাহু, কার বউ, তানহা, বেহুলা, আগুন নিয়ে খেলা, দুই ভাই, সংসার, আঁকাবাঁকা, আদর্শ ছাপাখানা, নয়নতারা, শপথ নিলাম, প্রতিশোধ, কখগঘঙ, কুচবরণ কন্যা, সুযোরাণী দুয়োরাণী, আপন দুলাল, সপ্তডিঙ্গা প্রভৃতি।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে এই শিল্পীকে নতুন পরিচয়ে পায় বাংলাদেশিরা। তিনি তখন একাধারে গানের কাজ করেছেন, পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের পরম আশ্রয় হয়ে ওঠেন। নিজে গেরিলা যোদ্ধা ও সংগঠক ছিলেন। তার বাসায় গেরিলাদের গোপন ক্যাম্প স্থাপন করেন। কিন্তু ক্যাম্পের কথা ফাঁস হয়ে গেলে ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট পাকিস্তান বাহিনী তাকে আটক করে। তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। তার বাসা থেকে আরও অনেক গেরিলা যোদ্ধাদের নিয়ে যাওয়া হয়। এদের অনেকের সাথে তিনিও চিরতরে হারিয়ে গেছেন।
পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তার দেশাত্মবোধক গান প্রচারিত হতে থাকে, যা অগণিত মুক্তিযোদ্ধাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। দেশ স্বাধীনের পর, ১৯৭৭ সালে মহান এ মানুষটিকে একুশে পদক প্রদান করা হয়। বাংলা সংস্কৃতি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অবদান রাখার কারণে তাকে এ পুরস্কার প্রদান করে সরকার।
২০০৪ সালে সংস্কৃতিক্ষেত্রে অসামান্য আবদান রাখায় শহীদ আলতাফ মাহমুদকে স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়। তাকে বিশেষভাবে স্মরণ ও সম্মান জানাতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে শহীদ আলতাফ মাহমুদ ফাউন্ডেশন। যা এখন ১৫ বছরে পদার্পণ করছে। ২০০৫ সালের ৩০ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে বিশিষ্ট চিত্রগ্রাহক বেবি ইসলামকে সম্মাননা প্রদানের মাধ্যমে শহীদ আলতাফ মাহমুদ ফাউন্ডেশনের যাত্রা শুরু হয়।
এরপর বিভিন্ন সময়ে এই পদক পেয়েছেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ড. এনামুল হক, সঙ্গীতশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন, সঙ্গীতশিল্পী অজিত রায়, সঙ্গীত পরিচালক খোন্দকার নুরুল আলম, সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ সুধীন দাস, স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠসৈনিক বিপুল ভট্টাচার্য, সঙ্গীত পরিচালক আলম খান, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, নায়ক রাজ রাজ্জাক, চিত্রশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার, সঙ্গীত পরিচালক মো. শাহ্নেওয়াজ, চিত্রশিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী, সঙ্গীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, সঙ্গীতপরিচালক আলাউদ্দীন আলী, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, নাট্য ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আলী যাকের, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মফিদুল হকের হাতে এই পদক তুলে দেয়া হয়। সর্বশেষ ২০১৮ সালে শহীদ আলতাফ মাহমুদ পদক পান সৈয়দ হাসান ইমাম ও ফেরদৌসী মজুমদার।