শহীদ জননী সাহান আরা বেগম চির শান্তিতে থাকুন

শহীদ জননী সাহান আরা বেগম চির শান্তিতে থাকুন

আজ আবার কেন ১৯৭৫ সালের কথা বলছি? ৭১-এর ১৫ আগস্ট তো একটি কালো তিলক। সেই তিলককে কেন স্মরণ করছি? না। আমরা নরপিচাশদের কথা বলতে চাই না। যারা জাতির পিতাকে হত্যা করেছে। হত্যা করেছে নববধূসহ শিশু সন্তানদের। তারা তো পাকিস্তানী বর্ববর বাহিনীর চেয়েও ঘৃণিত। সেই দিনের ঘৃণা ক্ষোভ, দুঃখ, কষ্টের মধ্যেও জীবন সংগ্রাম ছিল। আমরা সেই জীবন্ত ফসিলের কথা বলতে চাই। যিঁনি সেই মৃত্যুপুরির মধ্যে থেকে বুকে আগলে রাখার চেষ্টা করেছিলেন শিশু পুত্র সুকান্ত বাবুকে। তাঁর সেই চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয় নরপশুদের বুলেট। শিশু সন্তান সুকান্ত বাবু মায়ের বুকেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে। সেদিনের সুকান্ত বাবুর মা ৭৫’র ট্রাজেডির প্রত্যক্ষকারী শহীদ জননী সাহান আরা বেগম। অসীম সাহস নিয়ে সেই মৃত্যুপুরী থেকে আরেক পুত্র সাদিক, আজকের সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আাবদুল্লাহকে বুকের মধ্যে আগলে রেখেছিলেন। ৭৫-এ যিনি প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে স্বামী-সন্তানসহ সকলকে আগলে রেখেছিলেন,  সেই শহীদ জননী সাহান আরা বেগমকে স্বামী, সন্তান-স্বজন, রাজনীতি কেউ আগলে রাখতে পারলো না। তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। ৭৫’র ট্রাজেডির শহীদ জননী সাহান আরা বেগম, তুমি ভালো থেকো, আজ তোমাকে সেলাম।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর রাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়। একই দিন হত্যা করা হয় তখনকার কৃষিমন্ত্রী শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাতকে। সেদিনের ওই নির্মমতার মধ্যে গুলি খেয়ে প্রাণে বেঁচে যান সাহান আরা বেগম। কেউ তাঁকে সানু বলে ডাকতেন। কেউ কেউ বলতেন সাহান আরা আবদুল্লাহ। আহত অবস্থায় বেঁচে গেলেও সেদিন তাঁর কোলেই বর্বরদের গুলিতে নিহত হয় শিশু পুত্র সুকান্ত বাবু। ৭৫’র ট্রাজেডি বুকে ধারণ করে ৪৫ বছর ছিলেন বাংলার জমিনে। সুন্দর একটি দেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিসংগ্রামের সেনানী, ৭৫’র শহীদ জননী সাহান আরা বেগমের প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।

বরিশাল নগরের কাউনিয়া এলাকায় অন্য আর পাঁচটা কন্যার মতো বেড়ে ওঠেন সাহান আরা, আমাদের সানু ভাবী। ছাত্রজীবনে বরিশাল সরকারি মহিলা কলেজে থাকাকালীন ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। সেই পথচলায় ১৯৭১ সালের মুক্তি সংগ্রামের একজন হওয়া। পড়াশুনার পাঠের মধ্যেই শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াাবাতের পুত্র বর্তমান জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন ও পরিবীক্ষণ কমিটির আহ্বাক (মন্ত্রী) আলহাজ¦ আবুল হাসানত আবদুল্লাহর সঙ্গে জুটি বাঁধেন। এরপর সংসার আর রাজনীতির মাঠে সমানতালে ছুটেচলা তাঁর। ১৯৭১-এ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভেবেছিলেন স্বস্তি ফিরবে। ফিরেছিলোও। কিন্তু মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় চরম ট্রাজেডির মধ্যে পড়তে হয় সাহান আরা বেগমকে। ৭৫ এর নারকীয় হত্যাকা-ের পর চেনা মানুষগুলো তাঁর কাছে অপরিচিত হতে থাকে। শিশু সন্তান হারা মা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। ২১ বছরেরও বেশি সময় প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়তে হয়েছে তাঁকে।

৭৫-এর ১৫ আগস্টের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ১৫ আগস্ট ট্রাজেডির শহীদ জননী সাহান আরা বেগম বলেছিলেন,  ‘১৯৭৫ সালের সেই দিনের নৃশংতা বলা কঠিন। ওই দুঃসহ স্মৃতি আজো আমি বুকে চেপে বয়ে চলেছি। ওই দিনের স্মৃতি বলতে গেলে আমি আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়ি। সেদিন সেনা সদস্যরা বাড়িতে এসে আমদের সবাইকে দোতলা থেকে নীচে নামিয়ে আনেন। তখন আমার শ্বশুর সে সময়ের কৃষিমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবত বলেছিলেন, ‘তোমাদের কমান্ডিং অফিসার কে? জবাবে ঘাতকরা বলেছে, আমাদের কোন কমান্ডিং অফিসার নেই।’ এরপরই তারা ব্রাশ ফায়ার করতে থাকে। আমার চোখের সামনে আমার শ্বশুর আবদুর রব সেরনিয়াবতকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করেছে। আমরা তখন ভয়ে আতঙ্কে জড়োসরো অবস্থা। এর কিছুক্ষণ পর সেনা সদস্যরা ওই কক্ষে এসে আবার ব্রাশ ফায়ার করে। আমার শিশুপুত্র সুকান্ত বাবু গুলি খেয়ে আমার কোলে মারা যায়। আমার গায়েও বেশ কয়েকটি গুলি লাগে। একজন মায়ের কোলে শিশুকে হত্যা করার স্মৃতি যে কতটা যন্ত্রণার হয়, সেটা কেবল মা-ই বুঝতে পারে। সেই স্মৃতি আজো আমি বয়ে চলেছি। পরে আহত অবস্থায় আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও আমার সঙ্গে কাউকে দেখা পর্যন্ত করতে দেয়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যেমন স্বপরিবারে হত্যা করেছে ঘাতকরা, তেমনি আমি এবং আমার পরিবারকেও তারা শেষ করতে চেয়েছিল। আমি আহত হয়ে বেঁচে আছি। আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ কোনমতে প্রাণ বাঁচিয়েছেন। ১৫ আগস্টের ওই রকম দুঃসহ স্মৃতি যেন কোন মা কিংবা কোন পরিবারকে বহন করতে না হয়। আমরা চাই, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার বাস্তবায়ন হোক।’

এই হচ্ছেন ১৯৭৫ সালের আগস্ট ট্রাজেডির শহীদ জননী সাহান আরা বেগম। তাঁকে আমরা সবাই সাহান আরা আবদুল্লাহ বলি অনেকে। কারো তিনি ভাবী, কারো বোন, কারো কাছে স্নেহের ভালোবাসার সানু। আজকের বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর মা হিসেবে কি তিনি পরিচিত হবেন? হয়তো অনেকেই সেই পরিচয় দিয়ে তৃপ্তি পাবেন। কেউ বলবেন বাংলাদেশের ইতিহাসের আরেক স্বাক্ষী সাবেক চীফ হুইপ, বর্তমান মন্ত্রী মর্যাদার আলহাজ¦ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর স্ত্রী। সব পরিচয়ের উর্ধ্বে উঠে সাহান আরা বেগম একজন সংগ্রামী নারীর নাম। স্রোতের সঙ্গে এবং স্রোতের বিপরীতে নৌকা বেয়ে বেয়ে আমাদের সুন্দর আগামীর পথে আসতে কাজ করেছেন। রাজনীতির বাইরে সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকও ছিলেন তিনি। আজকে তাঁর স্বজন, সন্তান, রাজনৈতিক কর্মী এবং সাংস্কৃতির বুক খালি করে চলে যাওয়া মেনে নেওয়া কষ্ট। তাই আবারো মহিয়সী এই নারীর প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।