শিশুদের জন্য ভালো স্কুল চাই,ভালো বন্ধুও চাই

শিশুদের জন্য ভালো স্কুল চাই,ভালো বন্ধুও চাই

বাবা-মা হিসেবে সন্তান নিয়ে আমাদের উচ্চ আকাঙ্খা দিন দিন বাড়ছে। নিজে যা করতে পারিনি সেটা করার জন্য সন্তান বিশেষ করে শিশুদের ওপর মানসিক চাপ দিচ্ছি। বাবা-মা এবং অভিভাবকের প্রত্যাশা শিশুদের বোঝায় পরিণত হচ্ছে। যার ফলে একদল শিশু পাঠ্য বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। এসব শিশুদের পরিবার, সমাজ, সংস্কৃতি কিছুই থাকে না। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তারা ভালো কাজও পায়। কিন্তু কর্মজীবনে গিয়ে তারা কেবল অর্থ উপার্যন আর মানুষকে অবজ্ঞা ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না। আবার বাবা মায়ের প্রত্যাশা পূরণ করতে গিয়ে মেধাবী অনকে শিশুর আতুর ঘরেই মৃত্যু ঘটে। বাবা-মায়ের অজান্তেই শিশু পা বাড়ায় ভিন্ন পথে। যে পথ শিশুর বিকাশ এবং বেড়ে ওঠার পথে হুমকী হয়ে দাঁড়ায়। সে খবর অনেক বাবা-মা-ই রাখেন না। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের জন্য শিশুর ওপর থেকে প্রত্যাশার চাপ কমানো দরকার। শিশুদের জন্য যেমন একটা ভালো স্কুলের দরকার, তেমনি ভালো বন্ধুরও দরকার। সেই বন্ধু নির্বাচনে বাবা-মা এবং শিক্ষকদের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। যার অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে প্রতিটি ক্ষেত্রে। আর এই অভাবের ফসল শিশু বয়সেই ধূমপান, নেতিবাচক কাজে সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া, মারামারি, মাদকে নিমজ্জিত হয়।

কয়েক দিন আগে এক সহকর্মী তার মুঠোফোনে ধারণ করা ভিডিও চিত্র দেখালো। বরিশালের নামি একটি স্কুলের চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণিতে পড়–য়া ছাত্রদের ধূমপানের দৃশ্য। দৃশ্যটি দেখে রীতিমতো থমকে গেলাম। দলবেঁধে স্কুলের গ-ি ছাড়িয়ে প্রকাশ্যে ধূমপানের ওই দৃশ্য হতবাক করেছে। এই শিশুরা কি স্কুলে গিয়ে তারপর বেরিয়ে পড়েছে, না কি বাড়ি থেকে স্কুলের নাম করে ওই আড্ডায় মিলিত হয়েছে সেটা জানা সম্ভব হয়নি। কিন্তু ভয়াবহ ওই চিত্র দেখে এটা বোঝা গেছে, কেবল ভালো স্কুল হলেই সন্তান ভালো মানুষ হয়ে বেড়ে উঠবে এমনটা নয়। সেজন্য প্রয়োজন স্কুলের দায়িত্বপ্রাপ্তদের নজরদারী। প্রয়োজন প্রত্যাশার চাপ কমিয়ে সন্তানদের সঙ্গে বাবা-মায়ের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন। তা না হলে আগামীতে নামি দামি স্কুলের শিশুরা মুখ থুবড়ে পড়বে।

বেশ কয়েক বছর আগে এই একই স্কুলের ৭ম থেকে নমব শ্রেণিতে পড়–য়া ছাত্রদের কাছ থেকে ২৫ থেকে ৩৫ হাজার টাকা দামে মুঠোফোন জব্দ করেছিল স্কুল কর্তৃপক্ষ। সেইসব মুঠোফোনে পর্নো ছবি ও ভিডিওচিত্রে ভরা ছিল। দুঃখের বিষয় জব্দ করা মুঠোফোন ফেরত  নেওয়ার জন্য অভিভাবকও আসেননি। পরে কর্তৃপক্ষ অভিভাবক ডেকে ফোন ফেরত দেন। আমাদের বাবা-মায়ের অন্ধ ভালোবাসা সন্তানকে বেশি নেতিবাচক কাজের দিকে ধাবিত করে। অসুস্থ্য প্রতিযোগিতা শিশুর ওপর প্রভাব ফেলে। সন্তান স্কুলে যায় কি না, সে খবর রাখার মতো সময় অনেক বাবা মা’র নেই। তারা কেবল একটি ভালো স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে তাদের দায়িত্ব শেষ করেন। ২টা-৫টা গৃহ শিক্ষক রেখে অর্থ ব্যয় করেন। কেবল অর্থ ব্যয় এবং ভালো স্কুলই শিশু সন্তানকে সত্যিকার মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে না। পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন দৃঢ় না হলে অর্থ-বিত্তের চেষ্টা বিফল হবে।
একটা সময় ছিল স্কুলগুলোর শিক্ষকরা ছাত্রদের নজরে রাখতেন। কোন ছেলে স্কুলে আসলো না, কেন আসলো না সেটার খোঁজ নিতেন। বাড়িতে লোক পাঠানো হতো। তখন মুঠোফোন ছিল না। কিন্তু বন্ধন অটুট ছিল। এখন ইচ্ছে করলে কয়েক মুহূর্তে স্কুলে না আসা শিক্ষার্থীদের খোঁজ নেওয়া সম্ভব। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। এতো সময় কি শিক্ষকদের আছে? না নেই। কারণ তারা স্কুলে কেবল রুটিন কাজ করার জন্য আসেন। এরপর তো তার অনেক কাজ পড়ে আছে। সকালে বিকালে পালা করে পড়াতে হয়। মূলত শিক্ষা বাণিজ্যিকিকরণ এবং বাবা মায়ের উদাসিনতা সন্তানদের ভবিষ্যত অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

আমাদের সন্তানরা দেশের সম্পদ। ওরাই একদিন দেশকে নেতৃত্ব দেবে। ওদের সম্ভাবনাময় জীবনকে গড়ে তোলার দায়িত্বও আমাদের। কেবল আমাদের অবহেলা আর সচেতনতার অভাবে আমাদের সম্ভাবনাময সন্তানরা নেতিবাচক কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছে। তাই পরিবার থেকে দায়িত্বশীল ভূমিকা নেওয়া দরকার। দরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং প্রশাসনেরও সঠিক ভূমিকা নেওয়া।

বাবা-মায়ের প্রাণের সম্পদ তাঁর সন্তান। সেই সন্তান অনেক সময় বাবা-মায়ের কারণেই ধ্বংসের পথে হাঁটতে শুরু করে। বাবা-মা তাঁর সন্তানকে স্কুল কিংবা কলেজে পাঠাচ্ছেন। কিন্তু তাঁর সন্তান স্কুল-কলেজের গেল কি না সেই খবর তারা রাখছেন না। স্কুলের কথা বলেন কন্যা সন্তান কিংবা পুত্র সন্তানরা রাস্তা, পার্ক, ত্রিশগোডাউন এবং কীর্তনখোলার পাড়ে গিয়ে বখাটেপনা করছে। স্কুল কলেজের পোশাকে এখন এটা নৈমিত্যিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। আমরা অনেকেই এই ঘটনা দেখি। কিন্তু কোন প্রতিবাদ করি না। এমনকি স্কুল-কলেজকেও অবহিত করি না। ভয়, পাছে ওই সন্তানরা আমাদের আক্রমণ না করে। কিন্তু আমাদের স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরা একদিকে যেমন মাদকের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। তেমনি প্রেমের ফাঁদে পড়েও বিপথে যাচ্ছে।

স্কুল পালানো পুরানো রেওয়াজ। কিন্তু চতুর্থ-পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রদের দলবেঁধে ধূমপানের ঘটনা আধুনিক সময়ের রেওয়াজ বলেই মনে হচ্ছে। এই অবস্থার পরিবর্তন জরুরী। সেজন্য আমি যা করতে পারিনি, যেটা আমি হতে পারিনি সেটা সন্তানের ওপর চাপানোর চেষ্টা বন্ধ করতে হবে। সন্তানের সঙ্গে বন্ধু হয়ে থাকতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের আরও আন্তরিক হয়ে নজরদারী বাড়াতে হবে। আমাদের শিশুদের জন্য যেমন ভালো স্কুল দরকার, তার চেয়েও বেশি দরকার ভালো বাবা-মা, শিক্ষক ও ভালো বন্ধু।