সরল অংকের গরল কথা

সরল অংকের গরল কথা

ম্যাট্রিকের গণিত পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রের প্রথম প্রশ্ন একটি ‘সরল অংক’। অংকটি নিয়ে অনেকক্ষণ ধস্তাধস্তি-কোস্তাকুস্তি করেও মিলাতে না পারায় নির্ঘাত ম্যাট্রিক ফেল জেনে পরীক্ষার্থী গণিতের খাতায় ইংরেজি ভাষায় লিখে আসলেন ‘আফ্টার  সাম ক্যলকুলেশন আই কাম টু দ্যা কনক্লুশন, দ্যাট ম্যাট্রিকুলেশন এ্যাগজামিনেশন ইজ নট এ এগ্জামিনেশন বাট এ ইল্যুয়েশন ফর এ সিমপ্লিফিকেশন’। এর বাংলা অর্থ দাঁড়ায়, ‘অনেক হিসাব-নিকাশ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইলাম যে, একটি সরল অংকের জন্য গোটা ম্যাট্রিক পরীক্ষাই কোনো পরীক্ষা নয়, বরং একটা মায়া বা বিভ্রম’।

আমরা আজ এমনি একটি সরল অংকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। নামে সরল, অথচ পেট ভরা তার গরল। কিছুতেই মিলানো যাচ্ছে না। জানি না, আমার স্কুল-গণিত শিক্ষক (ব্রজমোহন বিদ্যালয়) অম্বিকা সরখেল স্যার, বারোমাস যার হাতের তালপাতার পাখার লম্বা হাতল ছাত্রদের পিঠের প্রতি-আঘাতে ঝুরঝুরে ব্রুশ বা মেশওয়াকের রূপ লাভ করতো। তিনি এই সরল অংক মেলাতে পারতেন কী না? আমি এই ব্যর্থছাত্র সরল অংকের গরল আবিষ্কারে সম্পূর্ণ অকৃতকার্য। তবে যে সূত্রটি মনে আসছে তা হলো সরল অংকের ‘বন্ধনী’ বা ‘ব্রাকেট’ভুক্ত অংশটুকু। কেবল ব্রাকেট নয়, মনে হচ্ছে গণিতের ব্রাকেটে ‘নাটক’ ঢুকে পড়েছে! অর্থাৎ ‘ব্রাকেটে পদাঘাত’। এই ব্রাকেট এবং পদাঘাত আমাদের সামনে এক পরীক্ষা এনে হাজির করেছে। দেশের সার্থক অভিনেতা ও নাট্য নির্দেশক অনন্ত হীরা এর নাম দিয়েছেন ‘জাগো, জাগো বরিশাল, তোমার সমুখে আজি পরীক্ষা বিশাল’। আজ এই বিশাল পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমরা বরিশালবাসী। সরল অংকটি ছিলো সরলের মতো সরল।

আজ থেকে একশত ছাপ্পান্ন বছর আগে এক মহাপুরুষের আবির্ভাব ঘটেছিলো এই বরিশালে। তিনি মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্ত (১৮৫৬-১৯২৩)। স্বাধীনতা সংগ্রামী, সমাজ হিতৈষী, শিক্ষানুরাগী, মানব দরদী, কর্মবীর সর্বোপরী মহাত্মা উপাধিধারী এই মানুষটি জীবনভর কাজ করেছেন মানবকল্যাণে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয় সম্বন্ধে তাঁর সোচ্চার উচ্চারণ ‘বরিশালবাসী সকলে ইহার ফলভোগ করিয়া জ্ঞানী, গুণী হউক- সুখস্বাচ্ছন্দ লাভ করুক- ইহাই আমার একমাত্র কামনা’। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ৭ নভেম্বর কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর বরিশালবাসী তাঁকে সম্মানিত করে নির্মিয়মান ‘বন্দেমাতরম হল’ ‘অশ্বিনীকুমার হল’ নামে নামকরণ করে (২৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩০)। আর এই সেদিন ২০১৮-এর জুলাই মাসে মহাত্মার স্মৃতিকে চির জাগরুক রাখতে বরিশাল মহাশ্মশানে একটি স্মারকস্তম্ভ তৈরি করে। আয়োজিত হয় ‘অশ্বিনী মেলা’ ‘অশ্বিনী স্মৃতি’ অনুষ্ঠান, দেয়া হয় ‘অশ্বিনী পদক’ ইত্যাদি- যা প্রমাণ করে ‘বরিশালের মানুষ অকৃজ্ঞ নয়’।

এ এক সরল অংক, সহজ এর সমাধান; মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্তের বসতবাটিতে প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামতো তাঁর নামেই হবে। এ কোনো দাবী নয়; বরিশালবাসী সকল মানুষের দায়। বরিশালবসীকে এই দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত করার অগ্রণী উদ্যোগ নিলেন বরিশালের ইতিহাস সচেতন জেলা প্রশাসক। তিনি ‘সরকারি বরিশাল কলেজে’র নামকরণ ‘মহাত্মা অশ্বিনীকুমার দত্ত সরকারি কলেজ’ রাখার একটি প্রস্তাব পাঠান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এটি আমলে নিয়ে মতামত চেয়ে চিঠি পাঠায় বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের কাছে। এমন চিঠি বোর্ডে প্রতিনিয়ত আসে, উত্তরও চলে যায় অবলীলায়। কিন্তু এই চিঠি নিয়ে শিক্ষাবোর্ড কেনো এমন জট পাকালো বোঝা গেল না। ব্যানারসহ রাস্তায় নেমে এলো ‘বরিশাল শিক্ষা বোর্ড কর্মচারী সংঘ’। ‘কলেজের নাম পরিবর্তন করা যাবে না’ দাবী সম্বলিত ব্যানার লটকিয়ে দেওয়া হলো বোর্ডভবনের মূল ফটকে। গোটা শিক্ষাবার্ড হয়ে পড়লো পক্ষপাতদোষে দুষ্ট! এব্যাপারে বোর্ড কর্তৃপক্ষ একেবারেই নিশ্চল, নিশ্চুপ। বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের সঙ্গে একসময় কিছুটা জড়িত থাকায় (প্রথম নিয়োগ কমিটি এবং প্রথম ‘আপিল এন্ড আরবিট্রেশন কমিটি’র সদস্য, মহামান্য রাষ্ট্রপতি মনোনিত ‘বোর্ড কমিটির সদস্য’ (২০১২-২০১৫)। যেটুকু জেনেছি তাতে ‘বরিশাল শিক্ষা বোর্ড কর্মচারী সংঘ’ নামে বোর্ডের ভেতরে বা বাইরে এমন কোনো দাবির পক্ষে-বিপক্ষে সংঘটিত হওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না। ‘বরিশাল শিক্ষা বোর্ড কর্মচারী সংঘ’-এর নীতিমালারও তা পরিপন্থি। শিক্ষাবোর্ড একটি স্বয়ংশাসিত ‘নিয়ন্ত্রক সংস্থা’। কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ সংক্রান্ত বিষয়ে মতামত দেওয়ার দায়িত্ব শিক্ষাবোর্ডের। তাই কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ বিষয়ে মন্ত্রণালয় মতামত চাইলে মতামত দেওয়ার আগেই ‘বোর্ড কর্মচারী সংঘ’ কোনো পক্ষ নিলে এবং বোর্ড কর্তৃপক্ষ সে ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকলে ‘শিক্ষাবোর্ড’ নামক প্রতিষ্ঠানটি তার নিরপেক্ষতা হারায়। শিক্ষাবোর্ড কিংবা জেলা প্রশাসন, শিক্ষা অধিদপ্তর কিংবা শিক্ষা মন্ত্রণালয় কেউ-ই এর দায়-এর বাইরে নয়। 

কেনো এমন হয়? আমরা কি সরকারি নিয়মরীতি তোয়াক্কা না করেই সরকারি চাকরি করি! এ প্রসঙ্গে একটি চমকপ্রদ সংবাদ হলো ২৩ জুলাই ২০২০ নাম পরিবর্তন না করার পক্ষে যারা রাস্তায় (অশ্বিনীকুমার হলের সামনে) নেমেছিলেন তাদের মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের একজন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। তিনি খোদ ব্রজমোহন কলেজেরই শিক্ষক! তিনি কলেজ শিক্ষক পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক বিকাশকুসুম দাস। তিনি বক্তব্যও রেখেছেন। এ প্রসঙ্গে আমার দুটি কথা।

এক. ব্রজমোহন কলেজের একজন ছাত্র হিসেবে আমার উচিৎ তাঁদের শ্রদ্ধা করা। কারণ ওই কলেজতো আমার শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান। তবে এঁদের কাছে শিক্ষাগ্রহণ বা এদের শ্রদ্ধা করার বোধকরি আর কিছু বাকি নেই। কেবল ভেবে ভারাক্রান্ত হই, এঁরা কি শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের বলবেন, সরকারি চাকরি, তাই বাধ্য হয়ে অশ্বিনীকুমার দত্ত প্রতিষ্ঠিত ব্রজমোহন কলেজে এসেছি, এখন অশ্বিনী বিরোধীতা করে কিছুটা পাপস্খলন করি! তোমরাও এই ব্রতে ব্রতী হও। এছাড়া আর কী উপদেশ দেবেন এই মানুষ গড়ার কাকিগররা?

দুই. ব্রজমোহন কলেজের একজন প্রাক্তন শিক্ষক এবং শিক্ষক-পরিষদের নির্বাচিত সহ-সম্পাদক হিসেবে বর্তমান শিকক্ষপরিষদের মাননীয় যুগ্ম সম্পাদক মহোদয়কে বলতে চাই, কলেজের শিক্ষক পরিষদের যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে কলেজ প্রতিষ্ঠাতার বিরুদ্ধে কোথাও কোনো বক্তব্য দিতে গেলে শিক্ষক পরিষদের সিদ্ধান্ত নিয়ে যেতে হয়। জানি না, ব্রজমোহন কলেজ শিক্ষক পরিষদ এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েছে কি না? শিক্ষক মহোদকে বলি, ব্রজমোহন কলেজেন গ্রন্থাগারের দোতলায় অবস্থিত ‘অশ্বিনীকুমার দত্ত জাদুঘর’টি কষ্ট করে একবার একটু দেখে আসুন। আশা করি আপনাদের চোখ খুলতে পারে। এতো গেলো সরকারের মধ্যে থেকে সরকার বিরোধীতার বীরত্বকাহিনী। 

এই বিরোধীতায় নেমেছেন বেশ কিছু সংগঠনের প্রতিনিধিরা। স্বাভাবিকভাবেই তারা নিজ নিজ সংগঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েই এসেছেন। না নিয়ে আসলে তার দায় তাদেরই। 

এসেছেন ২০১২ সালে সরকারি বরিশাল কলেজের নাম মহাত্মা অীশ্বনীকুমার দত্তর নামে করার দাবীতে অন্দোলনকারী এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সমীপে দেয়া স্মারকলিপিতে স্বাক্ষরকারীদের একটি অংশ। তারা আসতে পারেন দুটি পথে- ‘আত্মশুদ্ধি’ কিংবা বা ‘আত্মবিসর্জন’। ‘আত্মশুদ্ধি’ হতে পারে এমন যে, এতকাল যা করেছেন, তা সব ভুল, অশুদ্ধ, অশুভ মনের বিকৃতি কিংবা অপরের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে। এখন নিজের ভুল বুঝতে পেরে তওবা করে নিজের ঘরে ফিরে আসা। তাঁদের জন্য আলহামদুলিল্লাহ। ‘আত্মবিসর্জন’ এই অর্থে যে, কোনো মোক্ষ লাভের আশায় নিজের সমস্ত ভাবনা, অনুভব, অনুভূতি, কর্ম বিসর্জন দিয়ে মুক্তির পথ খোঁজা। এই পথের পরিণতি সুখকর নয়। মহাসমারোহে পূজোর শেষে জাকজমকপূর্ণ প্রতীমার মাঝ নদীতে বিসর্জনের পর যে পরিণতি, তার জন্য অপেক্ষা করা। 

এই আন্দোলনের একটি ব্যতিক্রমী সংযোজন মহাশ্মশান রক্ষা কমিটির সভাপতি মানিক মুখার্জী কুডুর অংশগ্রহণ! তিনি কি একবারও অশ্বিনীকুমার দত্তের স্মৃতি ফলকটির দিকে চোখ ফেরাননি? 

গভীর মন-বন্ধনের সূত্রে অন্দোলনে নেমেছে ইসলামী শাসনতন্ত্র অন্দোলন এবং তাদের ছাত্র সংগঠন। ১৮ জুলাই ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র অন্দোলন রাস্তায় অশ্বিনীবিরোধী অন্দোলন নিয়ে আর ২৫ জুলাই ‘বরিশাল ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণ কমিটি’র নামে শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাদ প্রেসক্লাবে গোল টেবিল বৈঠক করে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন। লক্ষণীয় এই দুটির মাঝখানে ২৩ জুলাই অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন সংগঠনের সম্মিলিত সমাবেশ। 

এই অংক কে কীভাবে মেলাবেন জানি না। যারা বড়ো বড়ো সংগঠনের নামে অশ্বিনীকুমার হলের সামনে অশ্বিনী বিরোধিতা করে বাহবা কুড়ালেন তারা কি জানেন না, ইসলামী শাসনতন্ত্র অন্দোলনের আদর্শ-উদ্দেশ্য, কর্মসূচি বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানের মূল নীতিমালার পরিপন্থি। ২০১১সালে গৃহীত বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীটি দেখে নিলে ভালো হতো। 

অশনি সংকেত. ‘বরিশাল ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণ কমিটি’র সভায় এক বক্তা সরাসরি বলেছেন, আশ্বিনীকুমার দত্ত তাদের শত্রু, এই শত্রুর নামে বরিশালে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতে পারে না। তাদের নতুন প্রস্তাব অশ্বিনী হলের নাম পরিবর্তন। এই বক্তব্য সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে আছে, যে কেউ দেখতে পারেন। বরিশালবাসী যদি তাদের এই ভাবনাকে মেনে নেন, সরকার যদি কোনো কারণে সরকারি বরিশাল কলেজের নাম পরিবর্তনের প্রস্তাবনা থেকে সরে আসে, তাহলে সেদিন সুদূরে নয় যেদিন দাবী উঠবে ‘শত্রুর নামে বরিশাল কলেজের নাম পরিবর্তন রুখে দিয়েছি, তাই চিহ্নিত শত্রুর বাবার নামেও এই শহরে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকতে পারবে না’। আশঙ্কা করি সেসময় এর প্রতিবাদ করার কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে কী না! কথা বলছিলাম, সরল অংকের গড়লতা নিয়ে। এই গড়লতা এক নিমিশে দূর হতে পারে সচেতন বরিশালবাসীর নিঃস্বার্থ ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস, প্রচেষ্টা। চাই কেবল ‘ব্রাকেটে পদাঘাতে’র অবশান।