জয় বাংলা রাষ্ট্রীয় শ্লোগান : বিচারপতি মিজানের স্মৃতি অটুট থাকুক

জয় বাংলা রাষ্ট্রীয় শ্লোগান : বিচারপতি মিজানের স্মৃতি অটুট থাকুক

১৯৭১ সাল। গোটা পাকিস্তান জয় বাংলা ধ্বনিতে প্রকম্পিত। মাত্র একটি স্লোগান বাঙালিকে একসূত্রে গেঁথে দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে উজ্জীবীত করতো এই স্লোগান। ৯ মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত হয় আমাদের স্বাধীনতা। কী এক অমিত স্লোগান আমাদের লাল সবুজের ঠিকানা হয়ে যায়। একটি স্লোগান আজকের বাংলাদেশ। কিন্তু স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় এসে বাংলাদেশের স্লোগান জয় বাংলা ভাগের মায়ের সন্তানে পরিণত হয়। মূলত পরিণত করা হয়। সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জয় বাংলা এক কেন্দ্রীক স্লোগান হয়ে যায়। জয় বাংলা বলতে কুণ্ঠাবোধ করেন অনেকেই। এটা আমাদের লজ্জা। এই লজ্জার হাত থেকে বাঙালির স্লোগান, বাংলার ঠিকানার স্লোগান সবার স্লোগান করার সিদ্ধান্ত নেয় উচ্চ আদালত। আর কালজয়ী এই রায় যিঁনি দেন তিনি হচ্ছেন বরিশালের কৃতি সন্তান বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারপতি এফ.আর.এম. নাজমুল আহসান মিজান। একটি রায়ের মাধ্যমে আবারো জয় বাংলা স্লোগান সবার স্লোগান হয়ে যায়। কোন সরকার নয় দেশের প্রধান বিচারালয়ের এই সিদ্ধান্ত অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। যে সাহসী রায় বিচারপতি মিজান দিয়েছেন সেজন্যে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকলেই হবে না। মিজানের স্মৃতি রক্ষায় সরকারের উদ্যোগ নিতে হবে।

বিচারপতি নাজমুল আহসান মিজান গত বছর করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মারা যাওয়ার আগে বিচারপতি মিজান আরও কয়েকটি যুগান্তকারী রায় দিয়ে ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছেন। তার মধ্যে যেমন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান সবার জন্য হয়েছে। অন্যদিকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সম্মানের সঙ্গে বিচারালয়সহ সর্বত্র রাখার রায়ও দিয়েছেন নাজমুল আহসান মিজান। দিয়েছেন দেশের মুক্তি সংগ্রামের অগ্রসৈনিক মুক্তিযোদ্ধাদের নামের আগে ‘বীর’ শব্দ বসানোর আদেশও। এর মধ্য দিয়ে বীরের জাতি বাঙালির মুক্তিযোদ্ধারা এখন বীর মুক্তিযোদ্ধার খেতাব পেয়েছেন। এমন অনন্য উদাহরণ সৃষ্টিকারী বিচারপতি নাজমুল আহসান মিজান আমাদের ঋণী করে গেছেন। এই ঋণ শেধ করার নয়। তারপরও তিনি যে ইতিহাসের অংশ হলেন, সেই ইতিহাস সংরক্ষণ করতে হবে। একই সঙ্গে বিচারপতি নাজমুল আহসান মিজানের স্মৃতি রক্ষায় রাষ্ট্রেরই উদ্যোগ নিতে হবে।

বরিশালের মাটি ও আলো-বাতাসে বেড়ে ওঠা নাজমুল আহসান মিজান প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে রাজপথে থেকে সাধারণ ছাত্রদের অধিকার আদায়ে কাজ করে গেছেন। পরে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পর্টির সঙ্গে যুক্ত হন তিনি।  রাজনীতি করতে গিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনও করেছেন মিজান। আইন বিভাগে স্নাতোকত্তর ডিগ্রি নিয়ে ১৯৮৬ সালে বরিশাল জেলা আইনজীবী সমিতিতে আইন পেশায় যুক্ত হন। ১৯৯৪ সালে নাজমুল আহসান মিজান হাইকোর্ট বিভাগে ও ২০০৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। ২০১০ সালে নাজমুল আহসান মিজান হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। গত বছর জানুয়ারিতে মহামান্য রাষ্ট্রপতি নাজমুল আহসান মিজানকে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেন। কিন্তু এরপর করোনায় আক্রান্ত হলে তিনি আর সুস্থ্য জীবনের ফিরতে পারেননি। গত বছর ৪ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুলোকে পাড়ি জমান।

বিচারপতি মিজান শোষিত বঞ্চিত মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করে গেছেন আমৃত্যু। বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ কমাতেও মিজান ভূমিকা নিয়েছিলেন। আগামী প্রজন্মের মাঝে বিচারপতি নাজমুল আহসান মিজানের কর্মময় জীবন তুলে ধরা আমাদের একান্ত কর্তব্য। তাঁর আদার্শ যেন দেশের সব বিচারকদের মধ্যে প্রোথিত হয়। এমন গুণি মানুষের স্মৃতি রক্ষায় রাষ্ট্র অবশ্যই উদ্যোগ নেবে এটা আমরা বিশ^াস করি।


সম্পাদক, দৈনিক ভোরের আলো