‘ডগলাস বোর্ডিং’: আমার জন্মস্থল
‘জানো, তোমার আর আমার জন্মস্থান এক’, জাহীদ লিখেছিলো আমাকে- ‘জাহীদ’ মানে জাহীদ হোসেন চৌধুরী, আমার বরিশাল জিলাস্কুলের বাল্যসখা। আমি একগাল হেসেছিলাম- ‘তা, জানবো না? দু’জনেই জন্মস্থানই তো বরিশাল’। ‘না, না, সে কথা হচ্ছে না। তুমি-আমি একই জায়গায় জন্মেছিলাম- ডগলাস বোর্ডিংএ। বলেছিল সে। বলে কি? আমি তো জানতাম, আমার বোন আর আমি জন্মেছিলাম ডগলাস বোর্ডিংএ- অন্য কেউ এখানে জন্মেছে বলে তো শুনিনি!
জাহীদ জানায়, শুধু সে যে ডগলাস বোর্ডিংএ জন্মেছে তাই নয়, তার স্ত্রীও সেখানে জন্মেছিলেন। তারপর ‘আস্তে আস্তে ভাঙ্গোর’ একে একে আমাদের কালের অনেকেই জানাতে লাগলেন যে, তাঁরাও ডগলাস বোর্ডিং এ জন্মেছিলেন। বোঝা গোল যে, আমাদের সময়ে বরিশালের মধ্যবিত্ত মা-বাবাদের একটি বিরাট আস্থা ছিল ডগলাস বোর্ডিংএর প্রতি। পরিচিত নাম ছিল সেটি শহরবাসীর কাছে, এবং ‘সদর হাসপতালে নয়, ডগলাস বোর্ডিংএ সন্তানের জন্ম হয়েছে’ এর মধ্যে বোধ হয এক ধরণের সুপ্ত আভিজাত্যেরও ছোঁয়া ছিল।
মোক্ষম প্রশ্ন তিনটি- কি ছিল ডগলাস বোর্ডিং, কোথায় ছিল সে’টি এবং সে সম্পর্কে আমার স্মৃতিই বা কি? খুব পরিস্কার ধারণা নেই। তবে যতদূর বুঝি এটি ছিল মূলত: ধর্মযাজিকাদের প্রদত্ত একটি মাতৃ-শিশু সেবাস্থল। ধারণা করি ঐ বোর্ডিং ছিল একদল ধর্মযাজিকাদের বাসস্থান যেখানে ইংরেজ, আইরিশ ও আমেরিকান ধর্মযাজিকাদের আমি দেখেছি ষাটের দশকে। এ সব ধর্মযাজিকারা সম্ভবত: বরিশাল শহরের নানান গীর্জার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এই বাসস্থানের একটি অংশে তাঁরা প্রসূতিসেবা, ধাত্রীসেবা ও শিশুসেবা দান করতেন। মনে হয়, মানব-সেবার একটি অংশ হিসেবেই তাঁরা এটি করতেন এবং সমাজ-সেবার একটি অংশ হিসেবেই তাঁরা ধাত্রীবিদ্যা শিখেছিলেন। তাঁদেরকে সবাই ‘সিস্টার’ বলে সম্বোধন করতেন, তাঁদেরকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হত তাঁদের নামের আগে সিস্টার বসিয়ে- যেমন- ‘সিস্টার ক্যাথরীন’ বা ‘সিস্টার জুলিয়া’।
কোথায় ছিল জগলাস বোর্ডিং? এখন চেনাতে পারবো কি না, জানি না, তবে চেষ্টা করা যাক। বরিশালের বগুড়া রোডের অক্সফোর্ড মিশনের কথা মনেথাকার কথা- সেই বিরাট পুকুর, বিস্তীর্ণ মাঠ ও বিশাল অদ্ভুত আকৃতির লাল দালান, উঁচু প্রাচীরে ঘেরা বিস্তৃত স্থান। সদর রোডের দিক থেকে যদি আসি, তা’হলে মিশন শুরু হওয়ার ঠিক সীমানায় হাতের বাঁয়ে আলমগীর স্যারের বাড়ি, তারপর ডানে আমার বন্ধু ইক্ষুদের (ইকবাল) বাড়ি, যার দেয়াল ঘেঁসে ব্রজমোহন (বি.এম.) স্কুলে যাওয়ার পথ। তার শুরুতেই একটি পুকুর, যার ওপারে নাজিমুদ্দীন স্যারের বাড়ি, যেখানে এখন স্যারের ছেলে টিপু (নাজমুল হাসান) থাকে। বগুড়া রোড অক্সফোর্ড মিশনের সীমানা ঘেঁসে যেখানে ডানে মোড় নিয়েছে। সেখানে ডান হাতি ছিল নাহার মঞ্জিল, ছোট্ট নালা পেরিয়ে। নাহার মঞ্জিল আমার সতীর্থ হুমায়ূনদের বাড়ি ছিল।
নাহার মঞ্জিলের উল্টো দিকে বগুড়া রোডের ঠিক মোচড়টীয় বাঁ দিকে একটা গলি চলে গিয়েছে- হেরিংবোন নমুনার। গলির শুরুতেই ডানে এক টুকরো সবুজ জমিসহ বগুড়া রোডমুখী একটি দোতলা সাদা বাড়ি ছিল। সেটা ছাড়িয়ে একটু বাদে একটি সাদা দোতলা বাড়িতে থাকতেন আমার উদ্ভিদবিদ্যার শিক্ষক অধ্যাপক সায়েখুল ইসলাম। ঐ যে গলি সেটা ধরে হাঁটতে থাকলে ডানদিকে ছিল একটি কচুরীপানা ভর্ত্তি পুকুর। আর ডানদিকে কালো রঙ করা টিনের বেড়া।
মনে আছে বেশ কিছুটা হাঁটলে পরে সামনে আলকাতরা রঙ কার একটা ফটক। সেটা খুলে ভেতরে ছিল মৌসুমী ফুলের বাগান, আর ডানে ব্যারাকের মতো টিনের লম্বা ঘর আর টানা বারান্দা। সে ঘরের ওপরে ছিল কালো অ্যাসব্যাস্টাসের ছাদ, দেয়াল কোলে টিনের আর তার টানা বারান্দা ছিল জালিতে ঢাকা। সে লম্বা ঘর ছিল ছোট ছোট কামরায় বিভক্ত। সেগুলোই ছিল প্রসূতি দেখা, শিশু সেবা এবং প্রসব ঘর। জানালা-দরজায় ছিল সাদা পর্দা- ঠিক চিকিৎসা কেন্দ্রের মতো। বাগানের ওপারে ছিল সত্যিকারের বোর্ডিং- ধর্মযাজিকাদের থাকার জায়গা। ও দিকটায় কখনো যাইনি। ডগলাস’ নামটি কোথা থেকে এসেছে, তা আমার জানা নেই।
ডগলাস বোর্ডিং এর কোন স্মৃতি রয়েছে আমার! উঁহু, আর সব মানুষের মতো নিজের জন্মের কথা আমার মনে নেই। শুনেছি আমি ডগলাস বোর্ডিংএ জন্মেছিলাম ভীষণ এক শীতের রাতে ১০.৪০ মিনিটে। না, আমার দুবছরের ছোট আমার বোনের জন্মের কথাও আমার স্মরণে নেই। আমার বয়স তখন তিন। ষাট দশকের প্রথম দিকে আমার দু’ভাইয়ের জন্ম হয় বাড়িতেই। যতি’দি ছিলেন ধাত্রী। আমরা তাঁকে লেডী ডাক্তার বলতাম। তিনি নিয়ম করে মাসে একবার মাকে দেখতে আসতেন। যতি’দির সঙ্গে ডগলাস বোর্ডিং এর কোন সম্পর্ক ছিল কি না জানি না। কিন্তু আমার সবচেয়ে ছোট ভা’য়ের জন্মের পরে দেখতাম, মাসে একবার ডগলাস বোর্ডিং থেকে এক ইংরেজ ধর্মযাজিকা আসতেন আমাদের বাড়িতে। শিশুস্বাস্থ্য সম্বন্ধে মা’কে পরামর্শ দিতে। তিনিই আমাকে বিশুদ্ধ উচ্চারণে ইংরেজিতে ১ থেকে ১০ বলা শিখিয়েছিলেন।
তবে শেষের কথা এসব নয়। ডগলাস বোর্ডিংএর যে স্মৃতি আমি বুকে বয়ে বেড়াই, তার জন্যে ফিরে যেতে হবে ১৯৫৭ সালে। সবকিছু মনে নেই- শুধু মনে আছে একটি ঘরে একটি মোটা শেওলা সবুজ রঙের কাঁচের ওপরে সাদা রঙের তোয়ালাতে মোড়া একটি অপরূপ শিশু। বড় বড় পাঁপড়ির আধ-বোঁজা চোখ আর মাথাভরা কালো চুল তার। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে আমার চোখ আটকে গেল তার কালচে নীল হয়ে যাওয়া ছোট্ট ঠোঁট জোড়াতে। অমন নীল ঠোঁট আমি কখনও দেখিনি। যেমন দেখিনি এ জীবনে আর কখনো আমার মা-বাবাকে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়তে। কাঁচের টেবিলে শায়িত সেই শিশুটি জন্মের একদিন পরেই আমাদের ছেড়ে যাওয়া ভাই। তাঁর নাম রাখা হয়েছিল মঈনুল হক। বেঁচে থাকলে ডগলাস বোর্ডিং এ জন্ম নেয়া আমার হারিয়ে যাওয়া ভাইটির বয়স হত ৬৩ বছর।
প্রথম ছবিটি অক্সফোর্ড মিশনের। দ্বিতীয় ছবিটি পরম স্নেহভাজন বিলকিস রানুর সৌজন্যে পাওয়া। পেছনে ডগলাস বোর্ডিং, সামনে দাঁডিয়ে মাঝখানে সিস্টার লুসি হল্ট, যাঁকে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়া হয়েছে। সিস্টার লুসির ডানদিকে (ছবিতে), তার পাশে রানুর বন্ধু শীলু। সিস্টার লুসির বাঁদিকে (ছবিত) আমার আরেক পরম স্নেহভাজন মানুষ উর্বী (রানুর কন্যা)।
লেখক: সেলিম জাহান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অর্থনীতির অধ্যাপক এবং বর্তমানে জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন পরিচালক।
ছবি: লেখকের সংগ্রহ থেকে নেওয়া।