আজো হিরণকে খুঁজে ফেরে বরিশাল

সেদিনও ছিল বৃহষ্পতিবার। আজও বৃহষ্পতিবার। মাঝখানে ৬ বছর অতিক্রম হয়েছে। ২০১৪ সালের সেই বৃহষ্পতিবার বিকেল তিনটা। বঙ্গবন্ধু উদ্যানে জনপ্রতিনিধিসহ উৎসুক নাগরিকদের ভীড়। সবার দৃষ্টি আকাশপানে। আকাশ থেকে নামবেন সবুজ বরিশালের সবুজ স্বপ্নের কারিগর। বিকেল সাড়ে তিনটায় বঙ্গবন্ধু উদ্যানের সবুজ ঘাস ষ্পর্শ করেন এই নগরের মৃত্যুহীন প্রাণ শওকত হোসেন হিরণ। সতেজ, সরব হিরণের নিস্তেজ শবদেহ নিয়ে আকাশপথে এসেছেন বর্ষিয়ান নেতা আমির হোসেন আমু, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আফম বাহাউদ্দিন নাসিম। সবুজ জমিনে শবদেহ গ্রহণ করলেন আরেক বর্ষিয়ান নেতা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ, আফজাল হোসেন, পংকজ দেবনাথসহ জাতীয় অনেক নেতা। ছিলেন দল-মত নির্বিশেষে বরিশালের নেতারাও।
বর্ষিয়ান নেতাদের কাঁদে মৃত্যুহনী প্রাণ হিরণের দেহ সবুজ ঘাস তখনো স্পর্শ করতে পারেনি। তার মধ্যেই পুরো বঙ্গবন্ধু উদ্যান জনসমুদ্রে পরিণত হয়ে যায়। কেন এমন দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল সেদিন? হিরণ কি জাদু করেছিলেন আমাদের? যার জন্য এতো মানুষ এসে ভীড় জমিয়েছেন? এই নগর প্রান্তরে কি ছবি এঁকেছিলেন হিরণ? সত্য, সুন্দর এবং সতেজ এক বরিশালের ছবি এঁকেছিলেন হিরণ। হিরণের আঁকা বরিশালের সবুজ ক্যানভাস যেন আছড়ে পড়েছিল বঙ্গবন্ধু উদ্যানে। মানুষের মনিকোঠায় স্থান করে নেওয়া হিরণ হ্যামিলিয়নের বাঁশিওয়ালা হয়ে গেলেন। হ্যামিলয়নের বাঁশিওয়ালার সঙ্গে হিরণের পার্থক্য শুধু জীবন আর মৃত্যু। হিরণ মৃত্যুহীন কিংবদন্তীর নাম। মানুষের ভালোবাসায় জয় করেছেন মৃত্যুকে। মৃত্যুহনী প্রাণ বলছি এই জন্য মৃত্যুকে তিনি ছাড়িয়ে গেছেন। দীর্ঘ ৬ বছর পরও বরিশালের মানুষ আজো তাই হিরণকে খুঁজে ফেরেন।
আধুনিক বরিশালের রূপকার, সবুজ বরিশালের সফল মেয়র শওকত হোসেন হিরণ। মাত্র সাড়ে চার বছরের মধ্যে পুরো বরিশালের ছবি পাল্টে দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের হিরণ বরিশালের হিরণ হয়ে উঠেছিলেন। তাই সব দলের মানুষ তাঁকে নিজের বলে কাছে পেতেন। তাই আজ করোনা মোকাবেলায় বরিশালের মানুষ হিরণকেই বেশি স্মরণ করছে। তার কারণ হিরণ সকল দুর্যোগে মানুষের পাশে থেকে সাহস যুগিয়েছিলেন। সকল দু:সময় থেকেছেন পাশে। তাই তো হিরণের মৃত্যুর পরদিন বঙ্গবন্ধু উদ্যানসহ পুরো বরিশাল এক মোহনায় মিলিত হয়।
মানুষের জন্য ভালবাসার প্রতিদান এমন হতে পারে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কষ্ট। সেদিন যে যেমন পেরেছেন ছুটে এসেছেন। দোকানদার, ব্যবসায়ী, রিকসা শ্রমিক, শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, সাংস্কৃতিক কর্মী, রাজনৈতিক নেতা সবাই এসেছেন প্রিয় মানুষ হিরণকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে।
কেন এই মানুষের ঢল? কেন এই জনসমুদ্র? কি ছিলেন হিরণ, কি কাজ করেছেন বরিশাল নগরের জন্য? কিশের প্রতিদান দিতে চৈত্রের রোদ উপেক্ষা করে মানুষের স্রোত বঙ্গবন্ধু উদ্যানে। মাত্র তো সাড়ে চার বছর বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলেন। এর আগে তো অনেকে পৌর চেয়ারম্যান থেকে মেয়র পর্যন্ত হয়েছেন। ছিলেন, আছেন। তাদের ত্রুটি কোথায়? এমন সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন বরিশালের সাধারণ মানুষ।
২০১৪ সালের নয় এপ্রিল হিরণের মরদেহ বরিশালে পৌঁছায়। তাঁকে দেখতে হাজার হাজার মানুষ ছোটে তাঁর বাসভবনের দিকে। রাস্তায় গরু নিয়ে যাওয়া এক ব্যক্তি বলে ওঠলেন ‘মেয়রের বাড়ি এদিক থেকেও যাওয়া যায়’। হিরণ তখন মেয়র ছিলেন না। এই সত্য বরিশালের নাগরিকরা জানেন, তবে মানতেন না। তাই তো আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা অন্য যে কোন দলের কর্মী ও সাধারণ মানুষের মুখে হিরণ হয়ে ওঠেন মেয়র হিরণ। সেই নামেই পরিচিতি ঘটে তাঁর।
নগরের যেখানেই চোখ যায় হিরণের কাজের ছাপ। বরিশাল নগরে সবুজ বৃক্ষের অর্ধেকের বেশি হিরণের লাগানো। স্বপ্ন ছিল সবুজের নগর তৈরি। রাস্তায় টিস্যু, থুথু ফেলতে নিষেধ করতেন হিরণ। নিজের আঙিনা পরিচ্ছন্ন রাখার তাগিদ ছিল। সূর্য ওঠার আগে নগরের আবর্জনা সরিয়ে নিয়েছেন তিনি। ৩০ ওয়ার্ডের বাড়ি বাড়ি থেকে বাঁশি বাজিয়ে ময়লা অপসারণের উদ্যোগও তাঁর। নগরে বালুর গাড়ি চলাচলে নিষেধাজ্ঞা এবং রাত জেগে তার তদারকি করেছেন হিরণ। নগরের সড়ক প্রসস্তকরণ, আলোর নগরীতে পরিণত করা, ফুটপাত নির্মাণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, বিনোদন কেন্দ্র, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণ, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালানা সর্বত্র অবদান ছিল হিরণের। তাই তো হিরণ সবার কাছে এত প্রিয়।
২০১৩ সালে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি সম্মেলন উপলক্ষে নগরে বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনাসহ দলের নেতাকর্মীদের বিলবোর্ডে ছেয়ে যায়। দুইদিন পর বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বরিশালে আসেন জনসভা করার জন্য। শওকত হোসেন হিরণ ওই জনসভা সফল করার জন্য দলের সব বিলবোর্ড সরিয়ে ফেলেন। সেই সব স্থানে মুহূর্তের মধ্যে খালেদা জিয়াসহ দলের নেতাদের ছবি বিলবোর্ড স্থান পায়। ওই জনসভা যাতে সফল হয় সেজন্য আগের দিন বঙ্গবন্ধু উদ্যানে বিএনপির জনসভাস্থল পরিবদর্শন করেন হিরণ। বরিশালের ইতিহাসে কোন ধরণের হামলা ও সহিংসতা ছাড়া বিএনপির ওই জনসভা সফল হয়।
আজো হিরণের শূণ্যতা পূরণ হয়নি। বর্তমানে বরিশাল নগরী শান্তির নগর হিসেবে পরিচিত। যার রূপকারও হিরণ। লাখো জনতার জানাজার নামাজ শেষে সেদিনকার শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেছিলেন, ‘সন্ত্রাসের বরিশাল শান্তির বরিশালে রূপান্তর করেছে হিরণ’।
বরিশালে আওয়ামী লীগের বাইরেও অন্য দলের নেতা-কর্মীরা হিরণের শূন্যতার কথা বলছেন। আজো হিরণের জন্য অশ্রু ঝরাচ্ছেন অনেকে। এরকম বলতে শুনেছি, ‘বরিশালে এত খারাপ মানুষ থাকতেও হিরণ ভাই চলে গেলন?’ তাহলে বরিশালের কি হবে। কে করবে উন্নয়ন কাজ? বিলাপ করে একজন বলছিলেন আমরা কি অভাগাই থাকব। ৫০ বছরেও বরিশালের কোন উন্নয়ন হল না। যে মানুষটা মাত্র কয়েক বছরে নগরের রূপ বদলে দিল সেই মানুষটা আমাদের মাঝে নেই। এটা কেমন বিচার বিধাতা। এমন কান্নার শব্দ আজো নগরময়।
এই কান্না থামাতে আবরও হিরণের মত একজনকে আসতে হবে। যিনি হিরণের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে রূপসী বাংলার কবি জীবনান্দ দাশের নগর বরিশালে সাজিয়ে দেবেন।
শওকত হোসেন হিরণ ১৯৫৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। প্রথমে জাসদের রাজনীতিতে যোগদান করেন। পরবর্তী সময়ে জাগদল, যুবদল, বিএনপির এবং ১৯৮২ সালে জাতীয় পার্টিতে যোগদান করেন তিনি। ১৯৮৮ সালে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৯৭ সালে তিনি যোগ দেন আওয়ামী লীগে। ২০০৩ সালে মহনগরের আহ্বায়ক এবং পরে মহানগরের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন। ২০০৮ সালে বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়ে বরিশালে ব্যাপক উন্নয়ন করে মানুষের মনে দাগ কাটেন। ২০১৩ সালের সিটি নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন। তবে ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনে শওকত হোসেন হিরণ বরিশাল-৫ সদর আসন থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় নির্বাচিত হন।
শওকত হোসেন হিরণ ২০১৪ সালের ২২ মার্চ রাত সাড়ে নয়টায় বরিশাল ক্লাবের লনে পায়চারি করার সময় পা ফসকে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পান। দ্রুত তাঁকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে রাত একটায় তাঁকে ঢাকায় পাঠানো হয়। ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে তাঁর মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করা হয়। ২৩ মার্চ তাঁকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়। সেখানে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে দ্বিতীয় দফায় অস্ত্রপচার হয়। পরে তাকে স্থানান্তর করা হয় সিঙ্গাপুরের গ্লেইন ঈগল হাসপাতালে। সেখানে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। ওই অবস্থায় ৩০মার্চ তাঁকে সেখান থকে আবার ঢাকায় ফেরত এনে অ্যাপোলো হাসপাতালে কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসে রাখা হয়। ৯ এপ্রিল সকাল সাতটায় তাঁর কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসব্যবস্থা খুলে নেওয়া হয়।