কমিউনিটি পুলিশিং সেবা, যেতে হবে বহু দূর

এমন একটা সময় ছিল যখন পুলিশ এসেছে শুনলে কেবল অপরাধী নয়, সব পুরুষরা গ্রাম ছেড়ে পালাত। তখন থেকে একটা প্রবাদ চালু হয়, ‘বাঘে ছুঁলে আঠেরো ঘা, আর পুলিশ ছুঁলে বাহাত্তর ঘা।’ হয়তো সাধারণ মানুষরা হয়রানীর শিকার হয়েই এমন প্রবাদ রচনা করে থাকবেন। তখন অপরাধের চেয়ে অপরাধীকে বেশি জঘন্য ভাবা হতো। এসব কারণে সাধারণ মানুষের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্কটা নেতিবাচক রূপ নেয়। তবে পুলিশ সম্পর্কে কেবল নেতিবাচক কথা না বলে তাদের ইতিবাচক কাজগুলোর মূল্যায়ন করতে হবে। সেজন্য কেবল মুদ্রার এপিঠ দেখলে হবে না, ওপিঠে যে সফলতার গল্প আছে সেগুলোও মানুষের সামনে তুলে ধরা দরকার। সেই চিন্তা থেকে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে আজেকের জনবান্ধব কিংবা জনতার পুশিল ভাবনায় পৌঁছেছে। পুলিশের সেবার সঙ্গে নতুন নতুন শব্দ যোগ হয়েছে। কেবল শব্দই যোগ হয়নি, সেবার পরিকাঠামোও বদলেছে। আজ পুলিশ নাগরিক একে অন্যের পরিপূরক হয়ে এক সঙ্গে কাজ করে চলেছে। এই ধারা মানব উন্নয়নে আরও আগে হওয়া দরকার ছিল।
ইংরেজি ৬টি অক্ষরের সমন্বয়ে গঠিত পুলিশ (চড়ষরপব) শব্দের অর্থ এতটা তাৎপর্যপূর্ণ যা বলার অপেক্ষা রাখে না। ৬টি অক্ষর বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় পুলিশ কতটা বুদ্ধিমত্তায় সমৃদ্ধ একটি বাহিনী। বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায়, ন¤্র, অনুগত, বিশ^স্ত, বিচক্ষণ সাহসী ও দক্ষ। কোন কোন ক্ষেত্রে কিছু পুলিশ সদস্যর কর্মকা-ে এমন সুন্দর শব্দগুলো কালিমায় লিপ্ত হয়। সেখান থেকে আলোর পথে ফিরলেও সেই গল্পটি চাপাই থেকে যায়। আধুনিক চিন্তায় আলোকিত পুলিশ অপরাধ কমানো এবং অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আগে ব্যবস্থা নিতে অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। তারপরও পুলিশ শব্দ শুনলে কেন মানুষ আঁতকে উঠবে? এমন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।
এখনো পুলিশের মধ্যে কিছু আগাছা রয়েছে। যারা বৃটিশ তত্বের ওপর ভর করে মানুষকে সংশোধনের সুযোগ না দিয়ে নিষ্পেষণ করতেই বেশি পছন্দ করেন। তবে আশার কথা হচ্ছে এসব আগাছা নিড়ানোর জন্য আধুনিক ও বিজ্ঞানমনষ্ক পুলিশিং ব্যবস্থার প্রবর্তন হচ্ছে। যার মাধ্যমে শুদ্ধাচারের আওতায় আসছে পুলিশ। জনকল্যাণে এবং মানুষের আস্থা অর্জনে কাজ করছে পুলিশ। যে কোন দু:সময়ে পুলিশের ভূমিকা প্রশংসার দাবি রাখে। এর মাধ্যমে নাগরিক ও পুলিশের মধ্যে দূরত্ব কমছে।
আধুনিক পুলিশের পরিবর্তন আমাদের আরও সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাবে। তবে এর জন্য প্রয়োজন মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনে কাজ করা। প্রয়োজন পুলিশ আইনের আরও অধুনিকায়ন। দেশ স্বাধীনের আগে পুলিশ বৃটিশ চিন্তায় পরিচালিত হতো। স্বাধীন হওয়ার পর বৃটিশ আইনের পরিবর্তন তেমন না হলেও পুলিশের পরিসেবা বদলাতে শুরু করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু বদলেছে। অবকাঠামো, জনবল বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চৌকস এবং মেধাবীরা পুলিশ পেশার সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় পুলিশী সেবায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। পুলিশ হচ্ছে দেশের অন্যতম বাহিনী যারা তৃণমূল থেকে শুরু করে সব পর্যায়ের নিরাপত্তায় নাগরিকদের কাছাকাছি থেকে কাজ করে। নাগরিকদের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে গিয়ে পুলিশ নানামূখি সমস্যার মধ্যে পড়ে। এসব সমস্যা থেকে উত্তোরণের পথ অনুসন্ধানও করতে থাকে পুলিশ। সেই লক্ষ্যে মানুষের আস্থা অর্জনে সময়, মেধা ও অভিজ্ঞতার ওপর গুরুত্ব দেয়। সরকারও পুলিশের জনবান্ধব হয়ে ওাঠার জন্য সব ধরণের সহযোগিতা করছে। যার মধ্য দিয়ে পুলিশ হয়ে ওঠে সাধারণ নাগরিকদের আত্মজ।
পুলিশ এখন যে কোন সময়ের চেয়ে মানবিক, জনবান্ধব এবং সবচেয়ে বড় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশে এবং দেশের বাইরে মর্যাদা পাচ্ছে। তারপরও কেন যেন পুলিশ এবং সাধারণ নাগরিকের মধ্যে দূরত্ব থেকেই যাচ্ছিল। এই দূরত্ব কমানোর জন্য নানা উদ্যোগ শুরু হয় দেশে এবং বিদেশে। পুলিশী সেবায় জোর দেওয়া হয় নাগরিক সম্পৃক্ততার ওপর। সমাজ থেকে অপরাধ প্রবণতা কমানো এবং প্রতিরোধে কেবল পুলিশ নয়, জনসম্পৃক্ততা থকতেই হবে। সেই চিন্তা থেকে আধুনিক চিন্তা ও দর্শন অনুসন্ধান শুরু।
১৮২৯ রবার্ট পিল নাগরিকদের সহযোগিতা নেওয়া এবং অপরাধ প্রতিরোধকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত বলে মনে করেন। ধরা হয় তিনিই প্রথম কমিউনিটি পুলিশের মূল্যবোধ অনুসন্ধান শুরু করেন। তবে বাংলাদেশে ‘কমিউনিটি পুলিশিং’ শব্দটি ২০ শতকের শেষদিকে ব্যবহৃত হয়েছিল। কেবল পুলিশ সংস্থার পূর্ববর্তী দর্শনের প্রতিক্রিয়া হিসাবে। কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মূল লক্ষ্য একটি নিরাপদ, সুশৃঙ্খল সামাজিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা ও বজায় রাখতে জনসাধারণকে সহায়তা করা। যদিও অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা কমিউনিটি পুলিশিংয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য, তবে এটিই একমাত্র লক্ষ্য নয়। কমিউনিটি পুলিশিং অপরাধের সমাধানের সঙ্গে অপরাধ প্রবণতা কমাতে অনুপ্রেরণা যোগায়। উন্নত বিশে^র সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশে কমিউনিটিং পুলিশিং ধারণা ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। কমিউনিটি পুলিশিং, বিট পুলিশিং ও ওপেন হাউজ ডে এর মাধ্যমে নাগরিকদের নিয়ে যে গণমুখী পুলিশিং ও মানবিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে মানব কল্যাণে তা সত্যিই প্রশংসনীয়।
পুলিশের অনেক অর্জনের ইতিহাস আছে। সেগুলো খুব একটা বেশি আলোচিত হয় না। তবে সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশের জনবান্ধব হয়ে ওাঠার ইতিহাস ভুলবার নয়। করোনা মহামারীতে বাংলাদেশে পুলিশের যে ভূমিকা সেটা ভুলে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। করোনা কিংবা কোভিড-১৯ মহামারীর সময় যারা জীবনবাজী রেখে নাগরিকদের ভালো রাখতে সহযোগী হয়ে নিরন্তরভাবে পাশে ছিলেন। ওই সময় খোলা চোখে সড়ক, বন্দর, হাট-বাজারের দিকে তাকালেই দেখা যেত একদল মানুষ বিরামহীনভাবে সামাজিক দূরত্ব কিংবা শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য নিবিড়ভাবে চেষ্টা চালাচ্ছেন। হাসপাতাল থেকে করোনা আতঙ্কে রোগী পালিয়েছে, তাদের খুঁজে আনতে কাজ করেছেন। বিদেশ থেকে দেশে এসেছেন, তারা কি করেন্টাইনে আছে কি না তার সন্ধান করেছেন। সড়ক ও নৌপথে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় মানুষের চলাচল ঠেকাতে কাজ করেছেন। ভ্রাম্যমান আদালতে সহযাগিতা দিয়েছেন। চাল আত্মসাতের সঙ্গে জড়িতদের আদালতে হাজির করেছেন। কখনো আবার বাড়ি বাড়ি ত্রাণের চাল ও খাবার পৌঁছে দিতে কাজ করেছেন। করোনাসহ কোন ঝুঁকিই তাদের বাড়ি কিংবা ব্যারাকে আটকাতে পারেনি। সারাদিন তারা আমাদের ভালো রাখতে বাইরে থেকেছেন।
করোনা মহামারীতে যখন সবাইকে ঘরে থাকতে বলা হয়েছে, তখনও পুলিশ মাঠে। ঘোষণা হলো সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত নাগরিকরা বাইরে থাকবেন না। তখনও রাতে দিনে সেই কাজের তদারকী করেছেন পুলিশ। করোনা মোকাবেলায় মাঠ প্রশাসনের সবচেয়ে বেশি শরীরী উপস্থিতি ছিল তাদের। কোন রকম ব্যক্তিগত সুরক্ষা ছাড়াই তারা এই দায়িত্ব পালন করেছেন নির্ভয়ে। কাচা বাজার, জনসমাগম ঠেকানোসহ সকল ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে তাদের যেতে হয়েছে। অথচ তাদের সুরক্ষা বলতে কেবল একটি মাক্স, কোন কোন ক্ষেত্রে গ্লভস পড়তে দেখা গেছে। তারা যেন করোনার ভয়কে জয় করতেই কোমর বেঁধে নেমেছিলেন। মাঠে যখন তারা কাজ করেছেন কখনো মনে হয়নি তারা করোনার ভয়ে ভীত। মনে হয়েছে তারা যুদ্ধের ময়দানে আছেন। এই যুদ্ধে জয়ী হতেই হবে। হয়েছেনও।
আজকের কমিউনিটি পুলিশিং সেবা এবং বিট পুলিশিং সেবার মাধ্যমে অনেক বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে পুলিশ। কমিউিনিটি পুলিশং ধারণা বদলে দিয়েছে সেবার গুনগত মান। অপরাধ নিরাময়ে এবং অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে জনগণ পুলিশের সহযোগী হয়ে কাজ করছে। সমাজ থেকে অপরাধ দূর করতে এখন সাধারণ নাগরিকরা পুলিশের একজন হয়ে ভূমিকা রাখতে পারছে। কমিউনিটি পুলিশের ইউনিয়ন, ওয়ার্ড, থানা ও মহানগর কমিটির সদস্যরা অপরাধ সংঘটিত হওয়ার আগেই তথ্য ও উপাত্ত দিয়ে পুলিশকে সহযোগিতা দিচ্ছে। এই ব্যবস্থায় নাগরিক সেবা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে সমাজ থেকে অপরাধ সংঘটনের হার কমছে। আধুনিক পুলিশ জনবান্ধব ও জনতার পুলিশ হয়ে উঠবেই।