চির নূতনেরে দিল ডাক

‘চির নূতনেরে দিল ডাক, পঁচিশে বৈশাখ, হে নুতন’। এমনি একটি আহ্বান তুলে বাংলা সাহিত্যকে আলোকিত করেছিলে যিনি, তিনি হচ্ছেন বাঙালির শিল্প, সাহিত্য সংস্কৃতির বাতিঘর বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আজ পঁচিশে বৈশাখ। বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬০তম জন্মবার্ষিকী। বাঙালি জাতির ঐতিহ্যকে মর্যাদার আসনে নিয়ে যাবার জন্য যেকজন মানুষের নাম বলতে হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাদের মধ্যে অন্যতম। আজ পঁচিশে বৈশাখ নতুনেরে ডাক দিয়ে তোমার জন্মদিনে আমাদের বিম্র শ্রদ্ধা।
বাংলা সাহিত্যের অনন্য কবি ও সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৮ মে (বাংলা-পঁচিশ বৈশাখ-১২৬৮) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মাতা সারদা সুন্দরী দেবী। রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুুরুষেরা খুলনা জেলার রূপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন। বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের অধিকারী বিশ্বকবি বাংলা ১৩৪৮ সালের বাইশে শ্রাবণ (ইংরেজী ৭ আগস্ট-১৯৪১) কলকাতায় পৈত্রিক বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাধারে কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার। আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতিলাভ করেন। লিখেছেন বাংলা ও ইংরেজি ভাষায়। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত হয়েছে। বিভিন্ন দেশের পাঠ্যসূচিতে তার লেখা সংযোজিত হয়েছে।
১৮৭৮ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ কবিকাহিনী ’প্রকাশিত হয়। এ সময় থেকেই কবির বিভিন্ন ঘরানার লেখা দেশ-বিদেশে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ পেতে থাকে। ১৯১০ সালে প্রকাশিত হয় তার ‘গীতাঞ্জলী’ কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য তিনি ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে তিনি সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠা করেন।
১৮৯১ সাল থেকে পিতার আদেশে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে এবং উরিষ্যায় জমিদারীগুলো তদারকি শুরু করেন। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন ছিলেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে স্বপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান। ১৮৭৮ থকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ত্রিশটিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন।
কবির ওপর প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মূলত কবি। বাঙালি সমাজে তার জনপ্রিয়তা বেশি সংগীত, ছোটগল্প আর নাটকে। তবে প্রবন্ধ, উপন্যাসসহ অন্যান্য বিষয়ে চর্চা চলে বাংলাদেশে। তিনি দুই হাজার গান রচনা করেন। এসব গানের অধিকাংশ তিনি নিজে সুরারোপ করেন। কবির লেখা ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। ভারতের জাতীয় সংগীতটিও কবির লেখা। বিশ্বে কোন এক কবির দুই দেশে জাতীয় সঙ্গীত অনন্য উদাহারণ।
জীবিতকালে তার প্রকাশিত মৌলিক কবিতাগ্রন্থ হচ্ছে ৫২টি, উপন্যাস ১৩টি, ছোটগল্প’র বই ৯৫টি, প্রবন্ধ ও গদ্যগ্রন্থ ৩৬টি, নাটকের বই ৩৮টি। কবির মত্যুর পর ৩৬ খন্ডে ‘রবীন্দ্র রচনাবলী ’ প্রকাশ পায়। এ ছাড়া ১৯ খন্ডের রয়েছে ‘রবীন্দ্র চিঠিপত্র।’ ১৯২৮ থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত কবির আঁকা চিত্রকর্মর সংখ্যা আড়াই হাজারেরও বেশি। এর মধ্যে ১৫৭৪টি চিত্রকর্ম শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত আছে। কবির প্রথম চিত্র প্রদর্শনী দক্ষিণ ফ্রান্সের শিল্পীদের উদ্যোগে। ১৯২৬ সালে প্যারিসের পিগাল আর্ট গ্যালারিতে চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়।
রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরের কবিতা ও গানের বাণীসহ সৃষ্টিকর্মের মূল সুর হচ্ছে ভাবগভীরতা, গীতিধর্মিতা, চিত্ররূপময়তা, আত্মচেতনা, ঐতিহ্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রেম, মানবপ্রেম, স্বদেশপ্রেম, রোমান্টিক, সৌন্দর্যচেতনা, বিশ্বপ্রেম, জীবনদেবতা। রয়েছে ভাব, ভাষা, ছন্দ ও আঙ্গিকের বৈচিত্র্য, বাস্তবচেতনা ও প্রগতিচেতনা। তার গদ্যভাষাও কাব্যিক। তার রচনাসমগ্রে রয়েছে, বাঙালির জীবনবোধ ও ঐতিহ্য সাধনার কালপ্রবাহ।
ভারতীয় উপমহাদেশের ধ্রুপদী ও লৌকিক সংস্কৃতি এবং পাশ্চাত্য বিজ্ঞানচেতনা ও শিল্পদর্শন তার রচনায় গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। কথাসাহিত্য ও প্রবন্ধগুলোতে রয়েছে সমাজ, রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে নিজস্ব মতামত ও মানুষের আকাঙ্খার প্রতিফলন। প্রগতিশীল, শিক্ষিত দেশ ও জাতি এবং বিশ্ব গঠনের বাণীও অধিকাংশকর্মে পরিস্ফূট হয়েছে। আজো রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্ম আমাদের সমস্যা থেকে উত্তোরণে পথ দেখায়। তাঁর মৃত্যুর এত বছর পরও তিনি সমধিক সমাদ্রিত হচ্ছেন দেশে দেশে। তাঁর জন্মদিনে পুনরায় আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।