পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিতে হবে

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে পরিবার পকিল্পনা সেবায় বাংলাদেশের সাফল্যের অর্জন রয়েছে। বর্তমানে দেশে মাতৃ মৃত্যু হার কমেছে। কমেছে বাল্য বিবাহের হারও। এতকিছুর পরও পরিবার পকিল্পনা সেবার বলতে কয়েকটি পদ্ধতির বৃত্তে আটকে দেওয়া হচ্ছে। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি নারী ও মায়ের জীবন রক্ষাকারী ব্যবস্থা। বিষয়টি সম্পর্কে ধারণা থাকলেও চিন্তা ও মননে ইতিবাচকভাবে এখনও মেনে উঠতে পারছে না সাধারণ নাগরিকরা। তাই তো পরিবার পরিকল্পনা ও প্রজনন স্বাস্থ্য সেবায় সাফল্য থাকলেও এখনও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন হয়নি। এই পদ্ধতিটাকে যতোটা কুসংস্কার দ্বারা প্রভাবিত করা গেছে, সেখান থেকে বিজ্ঞানমনষ্ক জ্ঞান দ্বারা প্রশাস ঘটানো চ্যালেঞ্জ হিসেবেই রয়ে গেছে। এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে হলে বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে দেখে পরিবার, সমাজ এবং রাস্ট্রীয় পর্যায়ে কাজ করা দরকার। পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিতে হবে।
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৭০ দশকে একজন মা ৭ থেকে ৮টা সন্তান জন্মদিত। এই সময়ে প্রতি এক লাখ মায়ের মধ্যে ৬০০ থেকে ৭০০ জন মারা যেত। গর্ভধারণে মায়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা না থাকা, অধিক সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে অসময়ে মায়েরা মৃত্যুর মুখে পতিত হতো। বর্তমানে সেখান থেকে উত্তোরণ ঘটেছে। বর্তমানে এই মৃত্যু হার লাখে দেড়শতে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। এক তৃতীয়াংশ মাতৃমৃত্যু কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে পরিবার পকিল্পনা পদ্ধতি ও সেবার কারণে। পরিবার পরিকল্পনা ক্ষেত্রে আমাদের এখনো অপূরণীয় চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনায় আমরা অনেক এগিয়েছি।
মার্তৃ মৃত্যু থেকে আমরা নিস্তার চাই। সেজন্য পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি এবং প্রজনন স্বস্থ্য সম্পর্কে আরো সচেতন হতে হবে। আমরা জানি মাতৃ মৃত্যুর ৩৫ ভাগ কমে পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণের কারণে। বাকিটা পরিবার পরিকল্পনা সেবার মাধ্যমে। অপরিণত বয়সে গর্ভধারণ, বারবার গর্ভধারণের ফলে নারী মৃত্যুর হার বেড়ে যায়। আমাদের দেশে বাল্য বিবাহের কারণে অপরিণত বয়সে এমনকি কিশোরী বয়সে গর্ভধারণ করছে। ফলে মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। বাল্য বিবাহ রোধ করার সঙ্গে সঙ্গে পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহার করলে অনাকাঙ্খিত এই মৃত্যু ঝুঁকি কমানো সম্ভভ। পরিবার পরিকল্পনা জীবন রক্ষাকারী বিষয়। যা, নারী, মায়ের মৃত্যু কমায়, কিশোরীদের মৃত্যু কমায়।
অন্য এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এখনো দেশের অ্যাডলোসেন যারা তাদের ৬০ ভাগের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে ১৮ বছরের আগে। এ ছাড়া ১৫ বছরের আগে ২২ ভাগ কিশোরীর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। ফলে এসব মায়েদের মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। এদের মৃত্যুর ঝুঁকি পরিণত বয়সের চেয়ে ৫ গুণ বেশি। ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে যাদের বিয়ে হচ্ছে তাদের মৃত্যু ঝুঁকি স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ। আবার ৩৫ বছরের বেশি বয়সের নারীদের ক্ষেত্রেও গর্ভধারণে মৃত্যু ঝুঁকি অনেক বেশি। কিশোরীদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা আরো বেশি। অপরিকল্পিত ও অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণ হচ্ছে। ফলে গর্ভ নষ্ট করার প্রবণতা বড়ছে। যার খেসারত দিতে হচ্ছে নারী কিংবা মাকে। এসব সমস্যা দূর করতে প্রথমত কম বয়সে বিয়ে না দেওয়া, ১৮ বছরের নীচে গর্ভধারণ না করা এবং বেশি বয়সে গর্ভ ধারণ না করে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। একই সঙ্গে অবশ্য অবশ্যই পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি গ্রহণ করা জরুরী।
এখনো আমাদের দেশে পরিবার পরিকল্পনা বলতে কেবল জন্মনিয়ন্ত্রণ বলে বোঝানো হয়ে থাকে। ব্যাপকভাবে সেটাই জানে। কিন্তু বাস্তবে এটা যে সঠিক নয় তার অনেক উদাহরণ আছে। আমরা পরিবার পরিকল্পনাকে কিছু সামগ্রি বলে মনে করি। খাওয়ার বড়ি, ক-মসহ কয়েকটি বিষয়মাত্র। এটা একটা প্রযুক্তি, এটা যে একটি জীবন রক্ষাকারী প্রযুক্তি সেবিষয়ে জানা বোঝার ঘাটতি প্রকট। মোটাদাগে পরিবার পরিকল্পটনাকে অবশ্যই খাওয়ার স্যালাইনের মতো জীবন রক্ষারী হিসেবে দেখতে হবে। অনাকাঙ্খিত গর্ভের কারণে এবং প্রসবের জটিলতার কারণে মাতৃ মৃত্যু হচ্ছে। কিন্তু পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারের ফলে এই অনাকাঙ্খিত মৃত্যু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সবাইকে বোঝাতে হবে, পরিবার পকিল্পনা কেবল একটি মেথড নয়। যদি একজন মায়ের স্বাস্থ ভালো না থাকে সেক্ষেত্রে মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যাবে। এখনে মায়ের স্বাস্থ্য কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ জরুরী।
প্রজনন স্বাস্থ্যর সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে পরিবার পরিকল্পনা। নারীর ক্ষমতায়নে এটা বেশ ভূমিকা আছে। একটা নারীকে ক্ষমতায়নে আনতে তার সিদ্ধান্ত নিতেও পরিবার পকিল্পনা অনেকাংশে ভূমিকা রাখে। তার স্বাধীনতা থাকবে কখন তিনি সন্তান নিতে চান। কতটা বিরতি নিয়ে সন্তান নেবে এবং সে কয়টা সন্তান নিবে সেটা সে নিজে সিদ্ধান্ত নেবে। সে কি পদ্ধতি গ্রহণ করবে সেটাও সে নিজে সিদ্ধান্ত নেবে। পরিবার পরিকল্পনার সঙ্গে প্রজনন স্বাস্থ্য সোবা পরিপূরক।
পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিতে অ্যাডভোকেসির দিকে বেশি নজর দিতে হবে। এখানে লজ্জাকে প্রাধান্য দিলে চলবে না। পরিবারের মধ্যে এব্যাপারে খোলামেলা আলোচনা হতে হবে। কিশোর কিশোরীদের এবিষয়ে সঠিক ধারণা দিতেই হবে। সঠিক সময় যাতে কিশোর কিশোরীরা প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে জানতে পারে সেজন্য বেশি বেশি উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে তাদের পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে লজ্জা নয়, সঠিক তথ্য সঠিক সময় জানাবার ব্যবস্থা করতে হবে। এব্যাপারে নীরবতা ভেঙে অবশ্যই আওয়াজ তুলতে হবে। দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তন করতে হবে। প্রজনন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি সব পর্যায়ের মায়েদের কাছে পৌঁছাতে হবে। তাহলে অনাকাঙ্খিত গভধারণ এবং মাতৃ মৃত্যু হার আরও কমে আসবে। আমরা একটি সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মাণে পরিবার পরিকল্পনাকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই।