বাংলাদেশে ৪২ বছর আগের স্মৃতি হাতরে বাবা-মায়ের পরিচয় খুঁজছেন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী মনোয়ার

বাংলাদেশে ৪২ বছর আগের স্মৃতি হাতরে বাবা-মায়ের পরিচয় খুঁজছেন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী মনোয়ার

বাবা মারা গেছে ছোট বেলায়। অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা করাতে ঢাকার তেঁজগাওয়ে মিশনারীজ অব চ্যারিটি হাসপাতালে গিয়েছিলেন মাত্র ৪ বছর বয়সে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই হাসপাতালেই মৃত্যু হয় মায়ের।

এরপর বড় হয়েছেন রাজশাহী উপ-শহরের এসওএস চিলড্রেস্ ভিলেজে (অনাথ আশ্রম)। রাজশাহীতে স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পাড় হয়ে পাড়ি জমিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানে বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত স্ত্রী আর ২ সন্তান নিয়ে ভালোই কাটছে তার দিনকাল। কিন্তু এতকিছুর পরও মানসিক প্রশান্তি নেই তার। আজ অবধি জন্মদাতা বাবা-মায়ের পরিচয় জানতে না পাড়ের আক্ষেপ কুড়ে খাচ্ছে তাকে। গত ১৯ বছরে দুই বার বাংলাদেশে এসে ঢাকার তেঁজগাও মিশন এবং রাজশাহীর অনাথ আশ্রমে গিয়ে নাড়ির খোঁজ করার চেস্টা করেছেন। কিন্তু যেখানেই গিয়েছেন নিরাশ হয়ে ফিরেছেন। তবে শিশু বয়সে ঢাকার মিশন, রাজশাহীর অনাথ আশ্রম আর বরিশালের কিছু অস্পস্ট স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান তিনি। সেই সূত্র ধরে রক্ত বন্ধনের সন্ধান পেলে আবারও জন্মভূমিতে আসতে চান তিনি।  

হতভাগা এই ব্যক্তির নাম মনোয়ার মুকুল (৪৬)। বাংলাদেশী বাংশোদ্ভুত স্ত্রী আর ২ ছেলে নিয়ে থাকেন অস্ট্রেলিয়ার সিডনীতে। সেখানে আইটি সেক্টরে চাকুরী করেন তিনি। 

রাজশাহী উপ-শহরের এসওএস চিলড্রেনস্ ভিলেজের কেস হিষ্টোরী অনুযায়ী, মনোয়ারের জন্ম ৩১ জুলাই ১৯৭৬ সালে। ১৯৮০ সালের ২৫ জুলাই এসওএস চিলড্রেনস্ ভিলেজে এডমিশন (ভর্তি) করা হয় তাকে। ৪ বছর বয়সের শিশু মনোয়ারকে সাথে নিয়ে চিকিৎসার জন্য তেঁজগাওয়ে মিশনারীজ অব চ্যারিটি হাসপাতালে যান তার মা। শিশুটির বাবা মারা গেছেন বলে মিশন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলো তার মা (অজ্ঞাতনামা)। চ্যারিটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মা মারা যায়। কিন্তু তার কোন ঠিকানা বা কন্ট্রাক্ট পয়েন্ট (যোগাযোগের স্থান) ছিলো না তাদের কাছে। চ্যারিটি হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী শিশুটির যাওয়ার (আশ্রয়) বা দেখভাল করার কেউ ছিলো না। শিশুটি তার মায়ের কথা ছাড়া আর কিছইু বলতে পারেনি তাদের। 

আশ্রমে প্রাথমিক স্থর শেষ করার পর ওই আশ্যমের ইয়্যুথ ফ্যাসিলিটিজ বিভাগে থেকে রাজশাহীর গর্ভমেন্ট ল্যাবরেটরী হাইস্কুল, সরকারী রাজশাহী কলেজ এবং সব শেষ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন তিনি। ২০০০ সালে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে মাস্টার্স শেষ করেন তিনি। মাস্টার্স অধ্যয়নরত অবস্থায় চলমান থাকাবস্থায়  

পাঠ চুকানোর সময় তৎকালীন রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমান রুয়েট) প্রভাষক হিসেবে কিছুদিন অধ্যাপনা করেছেন তিনি। প্রায় ৬ মাস প্রভাষকের চাকুরী শেষে ঢাকার তৎকালীন ডেসকোতে কম্পিউটার প্রোগ্রামার হিসেবে যোগদেন মনোয়ার। ডেসকোতে ৮ মাস চাকুরী করার পর ২০০৩ সালে উচ্চ শিক্ষা গ্রহনের জন্য অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান তিনি। উচ্চ শিক্ষা গ্রহন করে সিডনীতে তথ্য প্রযুক্তি (আইটি) খাতে চাকুরী করছেন মনোয়ার। ২০০৭ সালে বিয়ে করেন এক বাংলাদেশী তরুনীকে। তাদের দাম্পত্যে ২টি ছেলে সন্তান রয়েছে। 

পড়াশোনা-বিদেশ গমন সহ দাপ্তরিক বিভিন্ন কাজে বাবার নাম প্রয়োজন হলে শিশু পল্লীর মা এর স্বামীর নাম নিজের বাবার নাম হিসেবে চালিয়ে দেন মনোয়ার। 

সিডনী থেকে মুঠোফোনে মনোয়ার বলেন, রাজশাহী অনাথ আশ্রমে তার নাম মনোয়ার মুকুল রাখেন তাকে লালনকারী মা। পারিবারিক নাম ছিলো বদিরুল কিংবা বদি। আশ্রমে বুদ্ধি বলে ডাকতেন তাকে। মনোয়ার ইসলামী নাম হলেও তার বাবা-মা কোন ধর্মের অনুসারী ছিলো তা অস্পস্ট। তবে তার মা নাকফুল পড়তেন। 

মনোয়ারের ভাষায় তাদের বাসার কাছে একটি বড় রাইস মিল ছিলো। মিলে তার মা শ্রমিকের কাজ করতেন। মিলের সামনে ধান শুকানোর খোলা জায়গা এবং মিলের গা ঘেষে ছিলো ফসলের ক্ষেত। বাসার কাছে একটা বড় হাসপাতাল ছিলো। হাসপাতালের কাছেই ছিলো একটি ওভারহেড পানির ট্যাংকি। ট্যাংকির কাছে পুকুরে মাছ ধরতেন স্থানীয়রা। বাড়ির পাশে প্রতীমা সহ পূঁজা হতো। একবার মেলায় গিয়েছিলেন। রাত হয়ে যাওয়ায় মা তাকে নিয়ে এক নিকটাত্মিয়ের বাড়িতে রাত্রীযাপন করেন। তার কাছাকাছি দূরত্বে একটি সিনেমা হল ছিলো বলে ৪২ বছর আগের স্মৃতি হাতরে বলেন তিনি। 

বরিশাল নগরীর বেলতলা এলাকার আকিব ফ্লাওয়ার মিলের সত্ত্বাধীকারী মো. শাহজাহান জানান, ১৯৮০ সালে বরিশালের একমাত্র রাইসমিল ছিলো আমানতগঞ্জ মহাবাজ। অটোরাইস মিলের মালিক ছিলেন মোহাম্মদ সিকদার। 

মোহাম্মদ সিকদারের ছেলে বাদল সিকদার বলেন, তার এ ধরনের কিছু মনে পড়ছে না। ওই সময় যারা মিলটি চালাতেন তাদের কেউ বেঁচে নেই। তবে মিলটি ধান ক্ষেতের মধ্যে নির্মান করা হয়েছিলো। মিলের পেছনে একটি খাল রয়েছে। বর্তমানে মিলের জায়গায় টিচার্স ট্রেনিং কলেজ করা হয়েছে বলে তিনি জানান।