সারা বছর বাংলা ভাষার মর্যাদায় কাজ হোক

সারা বছর বাংলা ভাষার মর্যাদায় কাজ হোক

রবীন্দ্রনাথের ছোট বেলা গল্পে, তাঁর সেজ দাদা বলেছেন, ‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তারপর ইংরেজি শেখার পত্তন’। আবার গানে কবিতায় দেখি, ‘আমার প্রতিবাদের ভাষা, আমার প্রতিরোধের আগুন, দ্বিগুন জ¦লে যেন, দ্বিগুন দারুন প্রতিশোধে, করে চূর্ণ, ছিন্নভিন্ন শতষড়যন্ত্রের জাল যেন, আনে মুক্তি আলো আনে...’ রবীন্দ্রনাথ বললেও সেই কথা বাস্তবের সঙ্গে মিলছে না। কিংবা ‘উর্দ্যু অ্যা- উর্দ্যু শ্যাল বি দ্যা স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ অব পাকিস্তান’ এর প্রতিবাদে বাঙালির অমিত তেজ অনেকটাই ম্লান। সেই সময়ের প্রতিবাদি গান কবিতাও কেতাবে বন্দী হয়ে যাচ্ছে। আবার একুশের বক্তৃতায় এমনও শুনি, ‘ বাংলা ভাষা না রিয়্যালি সুইট’। এটা আমাদের জন্য লজ্জার বিষয়।

বর্তমান অবস্থা হয়েছে আগে ইংরেজি, তার আগেও হিন্দি, তারপর বাংলা স্থান পেলেও পেতে পারে। অথচ এক সমসয় এই বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য রক্ত দিতে হয়েছে। একুশ এলেই বাংলা ভাষা নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে দেশ জুড়ে। সর্বত্র বাংলা ভাষার প্রচলন করতে হবে। সড়কের ইংরেজি সাইনবোর্ড ভাঙার প্রতিযোগিতাসহ নানা উদ্যোগ। এমন সব উদ্যোগে আমরাও অনুপ্রাণিত হই। কিন্তু এই উদ্যোগ অনেকটা ফানুসের মতো ওড়ে। ফানুষে যতক্ষণ প্রদীপটি জ¦লে ততক্ষণ সেটি মহাশূন্যে ভাসে। প্রদীপ নিভে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফানুসেরও মৃত্যু ঘটে। বাংলা ভাষা নিয়ে চর্চা এবং আলোচনার ঝড়ও থাকে বছরের ২৮ কিংবা ২৯ দিন। মানে ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে। এরপর আর ভাষার মর্যাদা, শহীদ মিনার রক্ষাসহ এ জাতীয় আলোচনা আর কোথাও শোনা যায় না। কেবল ফেব্রুয়ারি মাস নয়, সারা বছর জুড়ে যেন বাংলা ভাষার মর্যাদা ও সম্মান রক্ষায় কাজ হয়।

আমাদের বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা হয়ে গেছে অনেকটা ছাগলের তৃতীয় বাচ্চার মতো। দুই বাচ্চা মায়ের দুধ পান করে, তৃতীয় নম্বরটি কেবল মাথা দিয়ে অন্য দুই বাচ্চাকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এমন অবস্থা হয় সে তখন জীর্ণ, শীর্ণ অবস্থা নিয়ে কোনভাবে বেঁচে থাকে। তরতাজা ইংরেজি এবং হিন্দি ভাষার দাপটে বাংলা ভাষা ছাগলের তৃতীয় বাচ্চার অবস্থান নিয়েছে। অনেকেই এই যুক্তির বিপক্ষে অবস্থান নেবেন কিংবা প্রতিবাদ করবেন। তাদের পক্ষে নানান যুক্তিও আছে। তাদের সেইসব যুক্তি খ-ন করা আমাদের কাজ নয়।

আমরা একুশে ফেব্রুয়ারির আলোচনায় প্রাজ্ঞ আলোচকদের মুখে এমনও বলতে শুনেছি, ‘আমাদের বাংলা ভাষা না রিয়ালি সুইট’। আমাদের মিষ্টি বাংলা ভাষাকে যখন বিজ্ঞ আলোচকরা ‘সুইট’ বলে সম্বোধন করেন, তখন মনে হয় ওনাদের ‘সুইট’ তেঁতুলের চেয়েও টক। মানুষ বাংলা ভাষা নিয়ে এমন বক্তব্যও প্রত্যাশা করে না।

আমরা চাই, সর্বত্র বাংলা ভাষার চর্চা ও প্রসার। চাই, ইংলিশ মিডিয়াম এবং ভার্সনগুলোর বাংলা নিয়ে তেলেসমতি বন্ধ হোক। ওইসব মিডিয়াম ও ভার্সনের শিক্ষার্থীদের বাংলার প্রতি অমর্যাদা বন্ধ হোক। বাংলা ভাষা তাদের সামনে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়। মিডিয়ামের ওই শিক্ষার্থীরা বাংলা ভাষা নিয়ে প্রতিনিয়ত কৌতুক করে চলে। আর আমরাও সন্তান আভিজাত্যপূর্ণ শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে ভেবে নেতিবাচক কৌতুক মেনে নেই। কখনো কখনো নিজেরাও ওই কৌতুকের অংশিজন হয়ে যাই। বাবা-মা হিসেবে নিজেকে মনে মনে ধিক্কার দেই। কেন বাংলা শিখলাম, তার চেয়ে ঢের ভালো ছিল ইংরেজি শেখা। আমার ভাষার অমর্যাদা করে তারা তৃপ্তির ঢেকুর গেলেন। এই ধারা বন্ধ করতে অবশ্যই উদ্যোগ নিতে হবে।

আমাদের রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শের-ই-বাংলা একে ফজলুল হকরা তো বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, আরবি সব ভাষায় সমান পারদর্শী ছিলেন। তারা তো কখনো আমাদের ভাষার অমর্যাদা হতে দেননি। এমন আরো অনেকে আছেন, তাদের কথা নাই বা বললাম। আমাদের জাফর ইকবাল, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, হুমায়ুন আহম্মেদ, আনিসুল হক, কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, ইমদামুল হক মিলন- এমন কতজনার নাম বলবো। নাম নিতে গেলে একটা বই হয়ে যাবে। তারা সবাই বাংলার বাইরেও অন্য ভাষায় সমান পারদর্শী। তারা তো বাংলা ভাষার মর্যাদা ক্ষুন্ন হতে দেননা। তাহলে আমদের সন্তানদের মিডিয়াম এবং ভার্শন শিক্ষার নামে কোন শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। তাই আবারো বলতে চাই, কেবল একুশে ফেব্রুয়ারি কিংবা ফেব্রুয়ারি মাস নয়, সারা বছর বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা হোক।

হতাশার কথা বললেও বাংলা ভাষা নিয়ে আশার গল্পও কম নয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় শুরু হয়েছে বাংলা একাডেমির আয়োজনে একুশের বই মেলা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মেলার উদ্বোধন করেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে অনন্য হয়ে আছে আমাদের এই বই মেলা। মাত্র ২৮-২৯ দিনে যত বই বিক্রি হয় এবং যত সংখ্যক নতুন বই প্রকাশ হয়, সারা বছরেও ওই পরিমাণ বই প্রকাশ হয় না। এটা নিঃসন্দেহে আশার সংবাদ। বাংলা একাডেমির বই মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলা ভাষার মর্যাদার ওপরই গুরুত্ব দেওয়া হয়েরেছ। এ ছাড়াও পুরো ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে মেলার মঞ্চের আলোচানায় বাংলা ভাষার সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় খুরোধার বক্তৃতা, আলোচনা, সমালোচনা শোনা যাবে। এরপর বছর জুড়েই উপেক্ষিত হবে বাংলা ভাষা। তবে অনেক লেখক ও পাঠক সরব থাকবেন। তাদের সংখ্যা গণনায় আসার মতো হয়ে ওঠে না।

‘মোদের গরব মোদের আশা, আ’মরি বাংলা ভাষা, তোমার কোলে তোমার বোলে, কতই শান্তি ভালোবাসা, আ’মরি বাংলা ভাষা’। আমাদের ভালোবাসার বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় সরকারসহ সবাই উদ্যোগী হবো।